শুরুর কথাঃ
আমরা কি আসলেই সিকিম যাচ্ছি ? আগের দিন পর্যন্তও আমি শিওর না । তবে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাচ্ছি এটা আপাতত ফাইনাল । আসামের গোয়াহাটি থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত ট্রেনের টিকেট কাটা আছে । শিলিগুড়ি নেমে অবস্থা ভাল থাকলে সিকিম যাব না হয় অল্টারনেটিভ অপশন দার্জিলিং অথবা কালিম্পং ।
অবস্থা ভাল-খারাপ নির্ভর করছে আমার স্ত্রী-কন্যার উপর । আমার মেয়ের বয়স যাত্রাকালিন সময়ে সাড়ে ৩। এই বয়সে সে এই দীর্ঘ ভ্রমনের ঝাক্কি সামলাতে পারবে কিনা বুঝতে পারছিনা । সিলেট থেকে ধরলে সব মিলিয়ে প্রায় ১০০০ কিলোমিটার । সময়ের হিসাবে ২৯ ঘন্টা । এত দীর্ঘ পথ সে আগে কখনো ভ্রমন করেনি । আমার নিজের মধ্যেই শংকা, রিক্স কি একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে?
প্রথম দিনঃ ডাউকি হয়ে মেঘালয় তারপর আসাম
অনিশ্চিত গন্তব্যের যাত্রায় সিলেট থেকে যেদিন বের হই সেদিন প্রচন্ড গরম , ৩৩-৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে । মরার উপরে খাড়ার ঘা হয়ে গেল ইমিগ্রেশনের দীর্ঘ লাইন । সেদিন ছিল সরকারি ছুটি । সব প্রসেস শেষ হতে সাধারনত এখানে এক থেকে দেড় ঘন্টা লাগে সেদিন লাগল প্রায় ৩ ঘন্টা ।
ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন শেষ করার পর সাধারনত আমার প্রথম কাজ হচ্ছে এক প্যাকেট লেইস চিপস কেনা । এদিকে তাড়াহুড়োতে সকালে নাস্তা করা হয়নি , সকালে ৭ টায় উঠেছি এখন ১১ টার ও বেশি , চিপস দিয়ে ব্রেকফাস্ট করলাম । আমাদের সিকিম সফরে অসংখ্য ভুলের মধ্যে প্রথম ভুল হচ্ছে তিব্র গরমে চিপস খেয়ে যাত্রা শুরু করা । কারনটা একটু পরে বলছি ।
ডাউকি থেকে শিলং পর্যন্ত গাড়ি রিজার্ভ করলাম । আমাদের যাত্রাসংগি হয়েছেন অপরিচিত এক বাংলাদেশি দাদা । তিনি যাবেন আসামের কাছাড়ে । গাড়িতে উঠেই দাদা নানা খেজুরে আলাপ শুরু করেছেন যার মুল বিষয় হচ্ছে সিলেট শহরে তিনি কাকে কাকে চিনেন এবং আমি তাদেরকে চিনি কিনা? দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমি খেয়াল করলাম আমি তাদের বেশিরভাগকেই চিনিনা । আসলে গরমের কারনে গুল্প জমছে না , গলে যাচ্ছে !
যাই হোক, চিপস খেয়ে আমার পরিবারের বমি পর্ব শুরু হল । সকালে না খেয়ে রওনা দেয়া বিশাল একটা ভুল হয়েছে । আমি চোখ বন্ধ করে কাত হয়ে মরার মত পরে আছি । খারাপ লাগছে । পাহারের প্রতিটা টারনিং ফিল করছি । মেঘালয়ের এই রাস্তা প্রতিবার খুব উপভোগ করি , আজকে পারছিনা ।
তবে মেঘালয়ের একটা ব্যাপার ভাল লাগে , অনেক গরমের দিনেও ঠান্ডা থাকে । আমরা শিলং এসে পৌঁছলাম দুপুর দুইটায় অথবা আড়াইটার দিকে । দুপুরে খেয়ে আবার গহাটির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিতে হবে । গহাটি এখান থেকে প্রায় ৩ ঘন্টার রাস্তা । আমাদের রাতের ট্রেন ১১ টায় । হাতে যথেস্ট পরিমান সময় আছে ।
আরাম করে খেয়ে সিম কিনলাম । সিম ছাড়া নিজেকে খালি খালি মনে হচ্ছে । কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিনা । মাত্র কয়েক ঘন্টার যোগাযোগহীনতায় এমন অস্থির অনুভব হয় অথচ আগের সময়ে মানুষ যখন দীর্ঘদিনের জন্য ভ্রমনে বের হত তাদের কি অবস্থা হত , তারাই জানে ! আমার আরেক সফরসঙ্গি সিফাত বেনাপোল সিমান্ত হয়ে কলকাতা হয়ে শিলিগুড়ি আসবে । তার সাথে যোগাযোগ রাখাটা খুব জরুরি । শিলিগুরি পৌঁছে আমরা একসাথে যাব ।
শিলং থেকে গহাটি যাওয়ার রাস্তা অনেক ভাল , আমাদের ঢাকা-চিটাগং হাইওয়ে এর মত , সমস্যা একটাই টারনিং অনেক বেশি । ড্রাইভার সাহেব খুব শান্ত ভঙ্গিতে ভয়ংকর স্পিডে ড্রাইভ করা শুরু করল , একেক্টা টারনিং এ আমরা একপাশ থেকে অন্যপাশে চলে যাই এই অবস্থা । জাব উই মেট সিনেমার শহিদ কাপুরের ড্রাইভিং এর কথা মনে পরে গেল ।
যাত্রাপথে পড়ে উমিয়াম লেক । শিলং এর লোকজন এই লেককে বলে বারাপানি । এই লেকটা অনেকটা আমাদের কাপ্তাই লেক এর মত । পানির ভেতরে ছোট ছোট টিলা । রক অন টু সিনেমাতে কিছু দৃশ্যের চিত্রায়ন হয় এই লেকে । যাওয়ার পথে গাড়ি থামিয়ে দেখে নিলাম উমিয়াম লেক । আমরা যখন লেক এ এসে পউছালাম তখন সন্ধ্যা নামে নামে , আকাশ লাল হয়ে আছে আর তার সাথে পানিও । কি সুন্দর দৃশ্য ! সুন্দর দৃশ্য সাথে কাউকে নিয়ে উপভোগ করতে হয় । সেই মুহুরতে পাশের সবাই তখন ঘুমে অচেতন ।
গোহাটীতে আমরা প্রবেশ করলাম রাত ৯ টায় । গহাটি শহর ভেবেছিলাম ছোট কোন অন্ধকার অন্ধকার ভাব এর শহর হবে কিন্তু দেখে চমকে গেলাম । বেশ বড় এবং মোটামুটি পরিচ্ছন্ন শহর । পথে হটাত চোখে পড়ল আমাদের দেশের হাতিল এর আউটলেট । আমাদের দেশে যেভাবে থাকে ঠিক একি রকম । গহাটি আমার ধারনার বাইরে বড় শহর । প্রায় ১ ঘন্টা লাগল শহরে একদিকে প্রবেশ করে অন্যদিকে এসে কামাক্ষ্যা জংশন আসতে । হিন্দু ধরমালম্বিদের জন্য এটী বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা ।
স্টেশনে ঢুকতেই হাসি চলে এল । কমবেশি সবাই পরিপাটি হয়ে মাটীতে গড়াগড়ি করে শুয়ে আছে । কেউ কেউ মশারি সহ শুয়ে আছে । এখানে প্রচুর ধার্মিক লোকজন্য আসেন বুঝা যাচ্ছে , একটু পর এখান থেকে সরাসরি ট্রেন যাবে পুরি , পুরিও অন্যতম বড় তীর্থস্থান ।
আমরাও আজকে যাব পুরি এক্সপ্রেসএ । হাতে সময় আছে প্রায় ২ ঘন্টা । রাতের খাবার খেয়ে প্লাটফর্মে এলাম । প্রচন্ড গরম , হাঁসফাস অবস্থা , শরিরে আর কুলাচ্ছে না । রওনা দিয়েছি সাত সকালে আবার যেতে হবে প্রায় ১৬ ঘন্টার পথ ।
অবশেষে গরমের কাছে পরাজিত হয়ে একটু পরে আমরাও প্লাটফর্মে লেটিয়ে গেলাম । যাদেরকে দেখে একটু আগে হাসাহাসি করেছি এখন আমরাও তাদের কাতারে চলে এসেছি । এখান থেকে অনেক ট্রেন যায় শিলিগুরি কিন্তু এই ট্রেন বেছে নিয়েছি কারন এটা এই স্টেশন থেকেই ছেড়ে যাবে , বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে উঠতে সুবিধা হবে ।
ট্রেন বেশ পরিচ্ছন্ন । একদম সময় মত ছেড়ে গেল । আমাদের পাশে এক পরিবার যাচ্ছে পুরি , সম্ভবত সমুদ্র দর্শনে , সাথে ছোট বাচ্চা , তাদের আনন্দের সিমা নেই । মজার ব্যাপার হচ্ছে তারা একদম সিলেটি ভাষাতে কথা বলছে । কিন্তু তারা ভারতিয় । ভারতের ৬ টা জেলার মানুষ এর ভাষা হচ্ছে সিলেটি । ট্রেন যাত্রা যে কোন ট্যুরের মজা অনেক খানি বাড়িয়ে দেয় । ট্রেন আমাদের আনন্দ দুঃখের আবেগের বিশাল একটা অংশ বহন করে । আর তাই যে কোন ভ্রমনের ট্রেন যাত্রার অংশ আমাদের বিশেষ ভাবে মনে থাকে ।
ট্রেন ছাড়ার ঘন্টা খানেক পড়েই ঘুমে অচেতন হয়ে গেলাম । অচেতন বললে ভুল হবে , সচেতন ঘুম । চারপাশে কি ঘটছে বোঝা যাচ্ছে ।
ঘুম ভাংল খুব সকালে , জানালার পর্দার ফাক দিয়ে আলো আসছে । দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে , স্টেশনের একপাশে রঙ করা একটা বেঞ্ছ । নিল আর সাদা রং । স্টেশন টা প্রায় জনমানবশুন্য । কোন হই হুল্লর নেই । অদ্ভুত প্রশান্তির একটা দৃশ্য । ইচ্ছা হচ্ছিল ট্রেন থেকে নেমে অই বেঞ্ছ এ বসে একটু চা খাই । এই দৃশ্যের কথা আমার অনেক দিন মনে থাকবে ।
সুন্দর সকাল , কথায় আছে মর্নিং শোজ দ্যা ডে । আজকে সেটা সত্যি হল না । সকালের সৌন্দর্যের পর ঘটতে থাকল একের পর এক ঝামেলা ।
ট্রেন চলা শুরু হল । আরও প্রায় ২ ঘন্টার রাস্তা বাকি । ট্রেনের এই পথ অনেক সুন্দর । একপাশে পাহাড় দেখা যাচ্ছে আর একটু পরপর নদী । মাঝে মাঝে চা বাগান আর সবুজ ফসলি জমি, সামনে অপেক্ষা করছে কাঞ্ছনজঙ্ঘা । মনের ভিতরে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ । জীবন সুন্দর , অনেক বেশিই সুন্দর !
শিলিগুড়ি ও কাঞ্ছনজঙ্ঘাঃ
যারা বই পড়েন তাদের জন্য শিলিগুড়ি বা জলপাইগুড়ি শহর আরেক রোমাঞ্চের নাম । সুনিল বা সত্যজিত এর অনেক বইয়ে ছিল এই শহরগুলোর কথা । আর অঞ্জনের গানে ছিল কাঞ্ছনজঙ্ঘা নিয়ে আবেগ। শিলিগুড়ি শহর আমাদেরকে আমন্ত্রন জানাল অঞ্জন দত্তের প্রিয় কাঞ্ছনজংঘা দরশনের মধ্য দিয়ে । কাঞ্ছনজঙ্ঘা পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম আর ভারতের সবচাইতে উচু পাহাড় । একটা সময় কাঞ্ছনজংঘাকে ধরা হত বিশ্বের সবচাইতে উচু পাহাড় । এভারেস্ট এর সাথে এই পাহাড়ের উচ্চতার তারতম্য খুব একটা বেশি না । শিলিগুড়ীর লোকজন অনেক ভাগ্যবান । সুবিশাল পাহাড় দেখে তাদের দিন শুরু হয় ।
ট্রেন থেকেই কাঞ্ছনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে । ট্রেন এসে থামল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে । ঢাকা থেকে যারা ট্রেনে আসেন তারাও এখানে এসে নামেন । এই জায়গা থেকে নেপাল , ভুটান , বাংলাদেশ খুব কাছে ।
স্টেশনের নামার পরে কাঞ্ছনের সাথে সাদর আমন্ত্রন জানালো প্যাকেজ ট্যুরের এজেন্ট । সিকিম ট্যুরে আমাদের সবচাইতে বড় ভুল ছিল এই এজন্টের আমন্ত্রনে পা দেয়া । শুধু পা বললে ভুল হবে পুরো শরীর দিয়ে দিলাম । তার মুল অফার ছিল তাদের প্যাকেজে যাই আর না যাই তাদের হোটেলে একটু ফ্রেশ হয়ে নেয়া । ক্লান্ত শরীরে এটা আমাদের জন্য একটা বড় অফার ছিল ।
শিলিগুরিতে প্রচন্ড তাপ। খালি আকাশে মাথা ধরে যাচ্ছিল । কিভাবে বাকি পথ পাড়ি দিব টেনশন হচ্ছে । তার উপরে ইনার লাইন পারমিট সম্পর্কে ধারনা নেই । এটা আরেকটা টেনশন । এই টেনশন কমানোর জন্য প্যাকেজ ট্যুর নিলাম , কে জানত এতে টেনশন কমার চাইতে বাড়বে বেশি ?
শিলিগুড়ীর মসৃণ রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছিল । সোজা রাস্তার ওপাশে বিশাল উচু পাহাড় দেখা যাচ্ছে , যেখানে এক বিশাল রহস্য অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য । এ যেন আরেক পৃথিবী । পাহাড় মানেই রহস্য , পাহাড় মানেই রোমাঞ্চ । পাহাড় মানেই ভালবাসা ।
সচরাচর আমরা যে পাহাড়গুলো দেখি যেমন মেঘলায় বা বান্দরবান এই পাহাড়গুলো থেকে সামনের পাহাড়গুলোকে আরেকটু উচু আর গাড় সবুজ মনে হচ্ছিল । একটু ভয়ংকরও । একটু পরেই এই পাহাড়ে উঠব , আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে পাহাড়ের ওই পাশেই সিকিম ।
দিল্লি বহুদুর , এই প্রবাদ এর পরিবর্তে সেদিন হয়ে গেল ‘সিকিম বহু দূর’ । শিলিগুড়ি থেকে সিকিম এর এই পথ আমাদের কাছে অনন্তকাল যাত্রার মত হয়ে গেল ।
প্রথম কারন , প্রচন্ড গরম । দুপুর এর কড়া রোদ গাড়ির গ্লাস ভেদ করে সরাসরি গায়ে এসে পরছে । সাধারনত পাহাড়ে প্রবেশ করার পর একটু ঠান্ডা লাগে , আজকে সেটা হচ্ছে না । দ্বিতীয় কারন আমার ছোট মেয়ে আর গাড়িতে জার্নি করতে চাচ্ছেনা । গরম ও খিদায় তার অসহ্য লাগা শুরু হয়েছে। তাকে একদিকে সামলে রাখতে হচ্ছে , তৃতীয় কারন আয়শা (আমার স্ত্রী) বমি করা শুরু করেছে । একের মধ্যে তিন অবস্থা । ইতিমধ্যে সিফাত (আমার কাজিন) এসে জয়েন করেছে আমাদের সাথে । সেও গরমে ঝিম মেরে আছে ।
একপাশে তিস্তা নদি ধরে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা । আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ওয়েস্ট বেংগল এর । আমাদের সিকিম নামিয়ে তাকে আবার ফেরত আসতে হবে । পথে তাকে একবার জানালাম ১০ মিনিটের ব্রেক দেয়ার জন্য । যদিও রিজার্ভ গারি , সে না করে দিল, কোথাও দাঁড়ানো যাবেনা ।
সত্যিকার অর্থে আমার চোখে পানি চলে এলো। প্যাকেজ নিয়ে কেন এই ভুল করলাম ? কেন বাচ্চা সহ সিকিম যাওয়ার মত বড় রিক্স নিলাম । নিজের বোকামিতে কস্ট হওয়া শুরু করল ।
তিস্তা নদীর নামটা সুন্দর কিন্তু পাহাড়ি স্রোতে যেভাবে নেমে এসেছে তাতে ভয়ংকর লাগছে । তারচাইতে ভয়ংকর ব্যপার হচ্ছে আমার মেয়ের পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে , তার ডায়পার পড়ানো কিন্তু সে ডায়পারে পটি করবে না । ড্রাইভারকে বললাম, আশেপাশে কোন রেস্টুরেন্ট আছে কিনা? ড্রাইভার বলল আছে আরও ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে , তার মানে আরও আধাঘন্টা ।
আমার মেয়ে পেটে ব্যাথায় চিৎকার করা শুরু করেছে । আয়শা বমি করছে , কড়া দুপুর আমার খিদায় আর গরমে অসহ্য লাগা শুরু হয়েছে । তৎক্ষণাৎ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি আর জিবনেও সিকিম আসব না । এটাই ফার্স্ট এটাই লাস্ট ।
প্রায় আধাঘন্টা ড্রাইভ করার পর অবশেষে একটা রেস্টুরেন্ট পাওয়া গেল । মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছি যাতে একটা হাই কোমড পাওয়া যায় । যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয় , এখানে সে ব্যবস্থা নেই তবে তালা দেয়া ভাল অয়াশরুম আছে কিন্তু সেটা লেডিস এবং ভিআইপি , আমাকে ঢুকতে দিবেনা। আমি ম্যানেজার এর হাতে পায়ে ধরলাম । ম্যানেজার এর মন গলল , আমাকে ওয়াশরুম এর চাবি দিল ।
ওয়াশরুমে ঢুকছি দেখে আরেকজন আপু নাক সিটকানো শুরু করেছেন । কিছু করার নেই আমাকে ঢুকতেই হবে । সব মিলিয়ে আমার মাথা আর তখন কাজ করছে না ।
এর জলন্ত প্রমান হচ্ছে প্রায় ১০ মিনিটের অয়াশরুম পর্ব শেষে মেয়েকে কোলে নিয়ে বের হয়ে এসে ৩-৪ মিনিট পর দেখি আমি তাকে পরিস্কার করাইনি !! জার্নির এই জায়গাটা আমার অনেকদিন মনে থাকবে , কি পরিমান স্ট্রেসের মধ্যে দিয়ে গেলে মানুষ এই কাজ করে ।
যাই হোক প্রকৃত অর্থে এটা ছিল আমাদের লাঞ্চ ব্রেক । কিন্তু আমরা কেউ লাঞ্চ করার সুযোগ পেলাম না । ড্রাইভার তৃপ্তি করে খেয়ে সিগারেট ধরিয়েছে, আমার কাজিন সিফাত এক পাশে ক্রমাগত চিপস আর চকলেট খেয়ে যাচ্ছে । আমার চোখের সামনে দুইজন সুখি মানুষ ।
অবশেষে সিকিম
যত যা কিছুই হোক সিকিমের রাস্তা অনেক সুন্দর । দুই পাশে উচু উচু পাহাড়, একপাশে তিস্তা নদি । এই সুন্দর রাস্তা আমি খুব কম উপভোগ করতে পেরেছি । আরেকটা অমানবিক ব্যাপার হচ্ছে এই প্রচন্ডে গরমেও আমাদের ড্রাইভার এসি ছাড়েন নি, খরচের কথা চিন্তা করে । এতো কম কো অপারেটিভ ড্রাইভার আমি কখনই দেখি নি ।
যাই হোক বিকাল বেলা এসে পৌছালাম রাংপো চেকপোস্ট । রাংপো থেকে ইনার লাইন পারমিট নিতে হয় । এই পারমিশন ছাড়া সিকিমে ঢুকা যায় না । রাংপো হচ্ছে ওয়েস্ট বেংগল আর সিকিম এর বর্ডার লাইন । রাস্তায় একটা গেট যেখানে সিকিমে আসার জন্য অভিনন্দন জানানো হচ্ছে । অবশেষে সিকিম আসতে পেরেছি যদিও যেতে হবে আরো দুই ঘন্টার রাস্তা । চেকপোস্ট এর ইমিগ্রেশন অফিসারদের ব্যবহার অনেক আন্তরিক , মুগ্ধ করল । যাবতিয় কাগজপত্র জমা দিয়ে নিলাম একটা সাদা কাগজ , এই কাগজ হচ্ছে আগামি কিছুদিন সিকিমে থাকার জন্য আমাদের অনুমতিপত্র ।
সিকিমের রাস্তা , মানুষজন , চালচলন ভারতের অন্য জায়গা থেকে আলাদা , অনেক টা ভুটান ভুটান মনে হয় দেখে । সন্ধ্যার দিকে আমরা গ্যাংটক আসলাম। সাড়ে ৫ হাজার ফুট উচ্চতায় এক পাহাড়ি শহর । হোটেল আগে থেকেই ঠিক করা ছিল ।পুরাতন স্টাইলের ভবন । হোটেল এর রুম থেকে বিশাল পাহাড় দেখা যায় ।
দেড় দিন লাগল সিলেট থেকে এই গ্যাংটক এসে পৌছাতে । পুরো ধকল সহ্য করে গোসল করে এসে টের পেলাম আমার জ্বর এসেছে । এত কাহিনি করে এত দূর জার্নি করে জ্বর আসলে তো হবে না। খালি পেটে দুইটা পেইন কিলার খেয়ে এক ঘন্টার একটা ঘুম দিলাম ।
ঘুম থেকে উঠে দেখলাম সন্ধ্যা নেমেছে । পাহাড়ে টিমটিম করে আলো জলছে । রাতের পাহাড়ে ছোট ছোট আলো দেখতে অনেক ভাল লাগে তবে খিদায় পাহাড় সিকিম গ্যাংটক সব অসহ্য লাগছে । সুকান্তের সেই কবিতার মত , পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি , পেটে খাবার না থাকলে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর দৃশ্যও অসহ্য লাগে ।
সন্ধ্যার পর পেটে খাবার পরল । খাবারের পর এমজি মার্গে শপিং পর্ব শুরু হল । বোঝা যাচ্ছে এই জায়গাটা হচ্ছে এখানকার প্রানকেন্দ্র । আমার পরিবারের অব্যাহত শপিং কার্যক্রম চলতে থাকল । আমি ঝিম মেরে এক জায়গা বসে রইলাম । শরীর একটু একটু ভাল লাগছে, তবে পুরোপুরি না । কালকে সকালে আবার রওনা দিতে হবে লাচুং এর উদ্দেশ্যে । যাত্রার দুই দিন ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে ।
লাচুং যাত্রা নিয়ে আমি একটু চিন্তিত, কিছুটা বললে ভুল হবে , বিশদ চিন্তিত । আমার চিন্তায় আরেকটু মশলা দিলেন স্থানীয় এক মহিলা । কথায় কথায় জানালেন লাচুং তো ম্যলা দূর , শুধু দূর না , অনেক কষ্ট , ১২ হাজার ফুট উচু হওয়াতে শ্বাসকষ্ট হয় । ভয়কে আরেকটু পাশে তাকিয়ে দেখি ফুচকা-চটপটির সাথে সাথে অক্সিজেন সিলিন্ডার , মাস্ক ও সেল হচ্ছে । মানুষ কিনছেও । একি মুসিবত ! কই আসলাম ?
মহিলা সিকিমের স্থানীয় , অনেক গল্প করলেন সিকিম নিয়ে, সাধারনত রাস্তায় দেখা হয়ে অপরিচিতদের সাথে এত গল্প কেউ করেনা ।
আমার কাজিন সিফাতের এতসব বিষয় নিয়ে কোন হা হুতাশ নেই সে প্রতি ৫ মিনিটে একবার কিছু না কিছু খাচ্ছে । আমার অবস্থায় সে কিঞ্ছিত দুঃখ প্রকাশ করার চেস্টা করছে কিন্তু সফল হচ্ছে না । আইসক্রিম খেতে খেতে সম্ভবত দুঃখ প্রকাশ করা যায় না । করলেও সেটা প্রকাশ পায় না ।
গ্যাংটক এ মনমুগ্ধকর প্রথম সকাল
রাতে কড়া ঘুম দিলাম । ভোরে ঘুম ভাংল , উঠে জানালা দিয়ে তাকাতেই আমি হতভম্ব । হোটেল এর জানালা দিয়ে যে বিশাল পাহাড় দেখা যায় তাকে উকি দিয়ে ওপাশে দেখা যাচ্ছে সুবিশাল কাঞ্ছনজঙ্ঘা । একদম স্পস্ট । এই প্রথম মনে হল সিকিম আসার সিদ্ধান্ত ভুল না ।
চুপচাপ কিছুক্ষন উপভোগ করলাম পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম এই পর্বতকে । কি সুন্দর আল্লাহর সৃষ্টি । পাহাড়ের উপরে বরফ জমে আছে । সূর্যের আলো এসে পড়ছে সেই বরফের উপর ।
আজকে সকালে আমাদের যাত্রা শুরু হবে লাচুং এর উদ্দ্যেশ্যে । লাচুং এখান থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার ভিতরে , হিমালয়ের পাশে এক অঞ্ছল । সকালে নাস্তা করে এক দফা তর্ক আর রাগারাগি করে নিলাম হোটেলওয়ালা দের সাথে , জঘন্য সার্ভিস এর জন্য । প্যাকেজে আসার খেসারত দিতে হচ্ছে । সিকিম আসার পর যতজনই শুনেছে আমরা শিলিগুড়ি থেকে প্যাকেজ নিয়েছি সবাই কেমন জানি একটা সহমর্মিতার সুরে বলেছে “বোকা নাকি?”
যা হোক লাচুং যাওয়ার জন্য সুমো গাড়িতে উঠলাম । তিন সিটে চারজন বসতে হয় । এই অবস্থায় ৭ ঘন্টা পাড়ি দিতে হবে । আমরা এখন সাউথ সিকিম থেকে নর্থ সিকিম যাব । আজকে আকাশে মেঘ জমে আছে । সিকিম এর বিশাল পাহাড় আর তার ফাঁকে ফাঁকে জমে আছে মেঘ । একেক দিকের খাদ ভয়ংকর গভীর । সবুজের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট রঙ্গিন বাড়ি ঘর দেখা যাচ্ছে । এই ধরনের সুন্দরকেই বোধয় কবি সাহিত্যিকরা নাম দিয়েছেন ‘ভয়ংকর সুন্দর’ ।
আমাদের লাচুং যাত্রার ড্রাইভার বয়সে অনেক তরুন । বয়স ২১ বছর । তার দুইটা এরকম সুমো গাড়ি আছে , আর দুইটা কিনার পর সে আর ড্রাইভ করবেনা , শুধু ঘুরবে । গাড়িতে উঠেই সে বলে দিয়েছে গাড়িতে ফুল সাউন্ডে গান চলবে । কেউ কোন প্রতিবাদ করতে পারবেনা । স্পিকার পিছনে , সিফাত বসেছে স্পিকার এর পাশে । তার এই দুঃসময়ে দুঃখ হল । কি আর করা ? যেতে তো হবেই ।
আমাদের সাথে যাবে একজন গাইড, তার বয়স ২৩ বছর , আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে ইন্ডিয়ান ছাড়া কেউ গেলে অবশ্যই গাইড নিয়ে যেতে হবে । জায়গাটা চিন-ভুটানের বর্ডারের খুব কাছাকাছি ।
যাত্রা পথের সবচাইতে ভাল সিট যেটা আমরা বুকিং করে এসেছিলাম সেটাতে সে বসবে , তাকে বসতে দেয়া না হলে গাড়ি চলবে না । মহা বিপদ তো ! এ কোথায় আসলাম ?
যাই হোক দুই জনের দুই আবদার মেনে নিয়ে শুরু হল আরেক কঠিন যাত্রা । ভয়ংকর এই রাস্তার আরেকটা ভয়ংকর দিক হচ্ছে এই রাস্তায় প্রচুর ল্যান্ড স্লাইড হয় । উপর থেকে বিশাল আকারের পাথর হুটহাট পরে যায় । গাড়ির উপরে পরলে গাড়ি একদম চ্যাপ্টা । যাওয়ার পথে এরকম একটা গাড়ি দেখলাম যেটার উপরে পাথর পড়ে প্রায় মাটির সাথে মিশে গেছে গেছে । এডভেঞ্ছারেস এক জার্নি ।
অনেক গুলো ভিউ পয়েন্ট থাকলেও আমাদের গাইড বেশিরভাগ ভিউ পয়েন্ট স্কিপ করে গেল । এর পেছনে একেক সময় একেক যুক্তি । হারামজাদাকে দুই গালে দুইটা চড় দিলে ভাল লাগত । আমাদের সামনে বসে এক স্প্যানিশ আর ইতালির এক সুন্দরি মেয়ে । দুই মাস হয়েছে তারা ইন্ডিয়া এসেছে , এখানে এসে তাদের পরিচয় । এখন তারা গারলফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড । যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে গাইড নানান ভাবে চেস্টা করছে সেই ইতালিয়ানকে পটানোর জন্য । সাথে বউ বাচ্চা না থাকলে অবশ্য আমিও একটু আধটু গল্প করার চেস্টা করতাম । সিফাতের সেই ঝামেলা নেই , সে ইতিমধ্যে ইন্সটাগ্রাম এর আইডি নিয়ে নিয়েছে ।
পথে দুইটা ওয়াটার ফলস দেখে নিলাম , এর মধ্যে একটা অনেক বিশাল , নাম নাগা ফলস । আমার এই ফলস অনেকটা আমাদের পান্তুমাই ফলস এর মতই । মাঝে মাঝে আমার জানতে ইচ্ছা করে সমগ্র ভারতে কতগুলো ঝর্না রয়েছে ।
নাগা ফলস দেখে আবার যাত্রা শুরু হল , আমার ড্রাইভারের জন্য দুঃখ হচ্ছে , এই কঠিন পাহাড়ি পথ তাকে প্রতিদিন যাওয়া আসা করতে হয়। আবার ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে দুর্ঘটনার ঝুকি । শুধু এই কারনে সে রাতে প্রচুর এলকোহল পান করে , যেটা না করলে তার ঘুম হয় না আর ঘুম ঠিক মত না হলে এই পথে ড্রাইভ করা খুব কঠিন ।
লাচুং এ ঢোকার জন্য পথে আরেকটা জায়গা থেকে পারমিশন নিতে হয় । সেই পারমিশন এর পথ আসতে আসতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল । এখানে প্রায় এক ঘন্টার একটা ব্রেক । সন্ধ্যার চা এর জন্য পারফেক্ট একটা জায়গা । পারমিশন নিয়ে রাতের এক ঘন্টা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম লাচুং এ । আসতে আসতে একটা বিশাল বাঁধ চোখে পরল , গুগল থেকে জানতে পারলাম এটা সেই বিখ্যাত তিস্তা ব্যারেজ । সাথে পাহাড় কেটে একটা টানেলের ভিতর দিতে যেতে হল । টানেলটা লম্বায় ১ কিলোমিটার । এই টানেল হওয়ার আগে লাচুং যাওয়া খুব ঝামেলার ব্যাপার ছিল । এতো দুর্গম এলাকায় এত কাজ ! না দেখলে বিশ্বাস হয় না ।
সাড়ে ৯ হাজার ফুট উচু লাচুং এ প্রবেশ করেই টের পাওয়া যাচ্ছে যে এটা একটা রিমোট এলাকা । টেম্পারেচর গ্যাংটক থেকেও কয়েক ডিগ্রি কম । কেমন জানি একটা অন্ধকার অন্ধকার জায়গা । তবে প্রচুর হোটেল আর রিসোর্ট আছে । আশে পাশে অনেক পাহাড় আছে বোঝা যাচ্ছে কিন্তু সেই পাহাড়ে কোন জনবসতি নেই । কারন অন্ধকার । আকাশ কেমন যেন অন্ধকার , অন্যরকম কাল রং । সবমিলিয়ে এই পরিবেশ আমাদের জন্য একজন নতুন ।
হোটেল এ ঢুকে একটু রেস্ট নিয়ে রাতের বেলা বের হলাম লাচুং গ্রাম দেখতে। জায়গায় জায়গায় প্রায় প্রকাশ্যে মদ্যপান চলছে , আমাদের ড্রাইভার ও তাদের মধ্যে একজন ! বেশি খেয়ে কালকে গাড়ি নিয়ে খাদে না পরলেই হয় । তার ভাষ্যমতে মদ খেলে সে ঠিক থাকে , না খেলে সমস্যা ।
যে হোটেলে এসেছি সেখানে মাথার উপর একটা কাল পাহাড় আছে বোঝা যাচ্ছে । আর ঝর্নার মত কোন জায়গা থেকে ক্রমাগত পানির আওয়াজ আসছে ।
গাইড জানাল পরের দিন ভোর ৫ টায় উঠতে হবে । সকালে উঠে আমরা যাব ইয়ামথাং ভ্যালি নামের একটা জায়গায় । ইয়ামথাং- চিয়ামথাং যে ভ্যালিই হোক । আমরা ক্লান্ত । হিসাব করে দেখলাম ৩ দিনে প্রায় ৩০ ঘন্টা জার্নি করে ফেলেছি । গড়ে প্রতিদিন ১০ ঘন্টা । আয়শাকে বললাম কালকের যাত্রা কেনসেল করে দেই , বাকিরা ঘুরে আসুক আমরা রেস্ট নেই । আমার ছোট মেয়ের কস্টের কথা চিন্তা করে এই কথা বলা । তবে প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেল ।
লাচুং এর হোটেল ছিল কাঠের , মাঝ রাতে ঠান্ডা বেরে গেল , ৯-১০ ডিগ্রি হবে । বাংলাদেশে তখনো ৩০ এর উপরে । শীতের সময় এই হোটেল বরফে ডোবা থাকে । বাচ্চাকাচ্চা বড় হলে শীতে আসব । পরদিন সকালের কথা ভেবে ভেবে আতংক নিয়ে ঘুমাতে গেলাম । কি একটা ভুল করেছি সিকিম এসে !
লাচুং এর সকাল
গাইড এর কথা মত সকাল সাড়ে ৫ টাতে উঠলাম । দাত ব্রাশ করতে করতে জানলা খুললাম । খুলতেই আমি থ । শুধু থ না , ক খ জ সব । বিশাল হিমালয়ের ক্ষুদ্র একটা অংশ দেখা যাচ্ছে আমার জানালার বাইরে । কালকে রাতের আকাশের অন্ধকার বিষয়টা এবার টের পেলাম , আকাশের অই কাল অংশটা ছিল হিমালয় । পাহাড় থেকে নেমে এসেছে লাচুং নদী । হালকা সবুজ রঙ এর ছোট কিন্ত তিব্র স্রোতের একটা নদী । সম্ভবত এটা ছিল আমার ছোট জিবনের সব চাইতে সুন্দর দৃশ্যের সকাল । এত সুন্দর দৃশ্যের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না ।
সিফাতের তখনও ঘুম ভানগে নি । তার রুম থেকে এই দৃশ্য দেখার সুযোগ ও নেই । আমি দৌড়ে গিয়ে তাকে ঘুম থেকে ঢেকে তুললাম , এনে আমার জানালার পাশে দাড়াতে সেও বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল । ৩ দিনে এই প্রথম আমাদের মনে হলে সিকিম আসার সিদ্ধান্ত ১০০% ঠিক ছিল । এমন দৃশ্য দেখার জন্য এত কষ্ট করাই যায় । প্রত্যেক মানুষকে জীবনে একবার হলেও হিমালয় দেখা উচিত ।
হিমালয় পাহড়ের উপর বরফ জমা শুরু হয়েছে , স্পস্ট দেখা যাচ্ছে । পাহাড় এত বিশাল হতে পারে? বিশালতা দেখে ভেবিছিলাম এটা কাঞ্ছনজংঘা , তবে পড়ে জানলাম কাঞ্ছনজঙ্ঘা এর থেকেও অনেক উচুতে ।
সকালের নাস্তা করে আমরা রওনা দিলাম ইয়ামথাং ভ্যালি । পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা , তবে ভয়ংকর না, সুন্দর রাস্তা । একপাশে লাচুং নদি ক্রমাগত বয়ে চলেছে তার পাশে হিমালয় এর নাম না জানা সব পাহাড় । আমরা ৯ হাজার ফিট থেকে আরো ৩ হাজার ফিট উপরে উঠে যাব এখন ।
ইয়ামথাং ভ্যালিতে এসে আমাদের বিস্ময় আরও বেড়ে গেল । হিমালয়ের যে পাহাড় গুলো দূর থেকে দেখেছি আমরা আছি ঠিক সেই পাহাড় এর পাদদেশে । ভ্যালিটা অনেকে সুন্দর, ডানে বামে চারিদিকে হিমালয়ের পাহাড় । মাঝখানে ঢালু মাঠের মত একটা জায়গা আর বয়ে চলে নিল রঙ এর লাচুং নদি । পাহাড়ের উপর মেঘ জমা শুরু হয়েছে । এই দৃশ্যগুলো অনুভব করা যায় লিখে বা ছবি তুলে বুঝানো যায় না ।
এত সুন্দর দৃশ্য দেখে আমরা কি করব বুঝতে পারলাম না । পাগলের মত চারদিক কিছুক্ষন ছুটাছুটী করলাম ।
ইয়ামথাং ভ্যালিতে আসলে কিছুটা শ্বাসকস্ট হয় । আমার আগে থেকে অল্প শ্বাসকস্ট ছিল । মজার ব্যাপার হচ্ছে এখানে এসে এর মধ্যে প্রায় ৫ বার ঢালু জায়গাটা উঠানামা করতে হল যার মধ্যে আমার মেয়ের কারনে ২ বার , প্রতিবারই উপরে উঠার সময় তাকে পিঠে নিয়ে উঠতে হয়েছে । এটা আরেক অবর্ণনীয় কস্ট । শেষের বার মনে হচ্ছিল ফুসফুস বের হয়ে আসবে ।
ইয়াম্থাং এ বেশি সময় কাটানোর সুযোগ আমাদের নেই । প্যাকেজে আসার এই এক যন্ত্রনা । হোটেল এ ফিরে খাওয়া দাওয়া করে আবার ফিরতে হবে গ্যাংটক এ । মানে আজকের দিনে আবার প্রায় ৮ ঘন্টার পাহাড়ি রাস্তা ধরে জার্নি ।
হোটেল এ ফিরে এসে লাঞ্চ করে লাচুং নদি দেখতে গেলাম । অবিশ্বাস্য স্রোতের নদি । এরকম অনেক নদী মিলে তিস্তা নদী হয়েছে । নদিতে বিশাল বিশাল পাথর , এই নদীর স্রোত এতো বেশি যে এখানে নামা মাত্র আপনাকে ভাসিয়ে কোথায় নিয়ে যাবে আপনি টের পাবেন না । তাই নদীর পারে প্রবেশের মুখেই বড় করে লিখে দেয়া না নামার জন্য ।
লাচুং থেকে ফিরে আসার পালা , এমন সুন্দর জায়গা থেকে ফিরে আসতে মন চাচ্ছিল না । সব ছেড়ে এই পাহাড়ে একটা ঘর বানিয়ে থাকতে পারলে খারাপ হত না ।
আবার গ্যাংটক
গ্যাংটক ফেরার জার্নিটা এত কস্টকর হল না । আকাশে মেঘ ছিল , রোদ কম থাকার কারনে একটু ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে ফিরতে পেরছি । যাত্রা সন্ধ্যায় পাহাড়ের উপর একটা রেস্টুরেন্ট এ চা খেলাম । বিকাল থেকে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে । বৃষ্টির কথা আলাদা ভাবে উল্লেখ করার একটা কারন আছে ।
গ্যাংটক
গ্যাংটক ফিরে মরার মত ঘুমালাম কিছু সময় । এদিকে বৃষ্টি থামছে না ।
সকালে ঘুম ভাংল কলকাতা থেকে আসা একদল ট্যুরিস্ট এর হইচই এ । বারান্দার রেলিং এ দাঁড়িয়ে তারা কাঞ্ছনজঙ্ঘা দেখছে , শুধু দেখছে না ভিডিও কল এ সবাইকে দেখাচ্ছে । আজকে তারা লাচুং এ যাচ্ছে দুইদিন থাকবে । আমরা কেউই তখন পর্যন্ত জানতাম কি ভয়ানক বিপদ এ তারা পরতে যাচ্ছে !
সে কথায় পরে আসি ।
সকালে বের হলাম শহর দেখতে । লাচুং এ যে দৃশ্য দেখে এসেছি এরপর আর কোন কিছুই ভাল লাগছে না । পানি পানি মনে হচ্ছে , প্রকৃতির থেকে আজকে শহর উপভোগ করছি বেশি , রাস্তা ঘাট , বাড়ি ঘর, মানুষের চলাফেরা ।
বিকালে আমাদের শিলিগুড়ির গাড়িতে উঠতে হবে । পুরো সফরের অরধেক কেটে গেলো গাড়িতেই । দুপুরে হালকা নাস্তা করে বিকালের সুমো গাড়িতে উঠলাম । আগেই বলেছি আমাদের এই পুরো প্যাকেজ শিলিগুরির এক ট্রাভেল এজেন্ট এর মাধ্যমে করা । যা বুঝলাম তাদের কথা এবং কাজে কোন মিল নেই । আমাদের এই সফর আরও সুন্দর হতে পারত , যদি না আমরা তাদের হেল্প নিতাম । তার এই হেল্প নেয়ার একমাত্র কারন হচ্ছে ইনার লাইন পারমিট এর ঝামেলা না হওয়া । কিন্তু ব্যপারটা এত সহজ জানলে এই ভুল করতাম না । নিজে নিজেই সিকিম এসে সব ঠিক করে নিতাম ।
সারাদিন আবহাওয়া ভাল থাকলেও যেতে যেতে আবার বৃষ্টি শুরু হল । অনেক বৃষ্টি , তিস্তার স্রোত বেড়ে চলেছে । গ্যাংটক কে পেছনে ফিরে আমরা যাচ্ছি বাংলার উদ্দ্যেশ্যে । দার্জিলিং এর পাহাড় দেখা যাচ্ছে , গাড়িতে গান বাজছে… কান্ট্রি রোড… অঞ্জন দত্তের কথা মনে হচ্ছে ।
একদিনে চার রাজ্য
যেতে যেতে একটা রেকর্ড হয়ে গেল আমার , ২৪ ঘন্টার ভিতরে সড়ক পথে চার রাজ্য । বিকালবেলা সিকিম থেকে রাতের বেলা ওয়েস্ট বেংগল এর শিলিগুড়ি, সেখান থেকে ট্রেনে করে সকালবেলা আসাম আর আসাম থেকে গাড়ি করে মেঘালয় এর সিকিম । চার রাজ্য , চার রকম ভাষা , চার ধরনের মানুষ ।
শেষ এর ট্যুইস্ট
শেষের দিন আমাদের বাংলাদেশ ফিরার ডেটলাইন । সকালে গোহাটি থেকে গাড়ি নিয়েছি , ৫ টার ভিতরে ডাউকি ইমিগ্রেশন এ থাকতে হবে । সুন্দর ভাবে গাড়ি চালাচ্ছে দেখে যাত্রা পথে ড্রাইভারের প্রশংসা করলাম । সে খুব খুশি হয়েছে । এত খুশি হয়েছে যে গাড়ির স্পড আরও কমিয়ে দিয়েছে । এতই কম স্পিড এ এসেছে যে আমরা ডাউকি এসে নামলাম ৬ টায় , ততক্ষনে ইমিগ্রেশন বন্ধ ।
তারমানে আজকে আর বাংলাদেশে ঢুকতে পারব না । ডাউকিতে একটা হোটেল নিতে হল । পকেট একদম খালি , সাথে বাংলাদেশি টাকা ছিল , হোটেল এর মালিককে বাংলাদেশি টাকা দিয়ে কোন মতে ম্যানেজ করলাম রাতটা থাকার জন্য । আমার প্রতি ট্যুরের আইকনিক ফিনিশিং হচ্ছে ফেরার সময় আমি একদম খালি হাতে ফিরি । দেশে ঢুকে একটা সিংগারা কেনার ও টাকা থাকে না ।
সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা নিউজ দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম । আমরা যেদিন লাচুং থেকে ফিরে এসেছি তার পরদিন মানে গতকাল সেখানে প্রচন্ড বৃষ্টি আর পাহাড় ধ্বসে বন্যা হয়ে ভেসে গেছে অনেক সেতু । এখন পর্যন্ত মারা গেছে ১৪ জন । যারা ট্যুরিস্ট তারা আটকে গেছেন অনির্দিষ্ট কালের জন্য , হেলিকপ্টার ছাড়া ফেরার রাস্তা আপাতত বন্ধ ।
গায়ে কাটা দিয়ে উঠল , ওইযে কলকাতার কিছু ট্যুরিস্টদের কথা বলেছিলাম তারাও তাহলে আটকে আছে এখন ওখানে । আর আমরা বেচে গেচ ওখানকার প্রাকৃতিক অবস্থা খুব খারাপ । মাত্র এক দিনের ব্যবধানে বড় বিপদ থেকে বেচে গেছি ।
ছোট বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এতো দূরে এই বিপদে পরলে না জানি কি হত ! সিকিম সফরের এমন সিনেমাটিক সমাপ্তি সব মিলিয়ে মনে থাকবেন অনেকদিন , অনেকদিন বললে হয়ত ভুল হবে , আজীবন ।
0 মন্তব্যসমূহ