জাহাজের নাম কর্ণফুলী :: কেমন ছিল যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা?

জীবনের প্রথম সাগরযাত্রায় যাচ্ছি , জাহাজে করে । জাহাজের নাম কর্ণফুলী । জীবনে জাহাজ নিয়ে অনেক সিনেমা দেখেছি সে কারনেই হয়ত ভেতরে ভেতরে অনেক এক্সেপ্টেশন !

তবে কক্সবাজার থেকে সেন্ট মারটিন্সের জাহাজ দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল । মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম দেখব বিশাল এক জাহাজ , টাইটানিক না হলেও এর থেকে হয়ত একটু ছোট,  কিন্তু একি ? আমাদের সদরঘাটের পারকিং এ থাকা বরিশালের লঞ্ছ ও তো এর চাইতে কয়েকগুন বড় থাকে।  

আমি আবার জলভিতু প্রকৃতির, সাতার জানিনা । জাহাজ দেখে ভয়ের ঢোক গলায় দলা পাকিয়ে এল । এই বিশাল সাগরে কিভাবে পাড়ি দিব এই লঞ্ছ মারকা জাহাজে?  টিকেট কাটা , রিটার্ন সহ । পাক্কা দুই হাজার টাকা করে জনপ্রতি । নয়ত পেট ব্যাথা বলে আবার হোটেল এ ফিরে যেতাম । এই প্রথম বুঝলাম জীবনের চেয়ে টাকা মুল্যবান !

বিপদে পড়ে ঈমান চাংগা হয়ে উঠল , দোয়া দুরুদ পড়ে ডান পা টা সামনে দিয়ে জাহাজে উঠলাম , তখন ভোর ৫ টা । চারিদিক অন্ধকার । জাহাজ রাখা কক্সবাজার জেটির ছয় নাম্বার ঘাট এ, মোহনায়। 

ঠিক ৫ টার একটু পরেই জাহাজ ছাড়ল । আমাদের চোখে মুখে উত্তেজনা । প্রথম সাগর যাত্রা । সাতার জানিনা , এবারের মত বেঁচে ফিরে আসলে ভাল হয়ে যাব , এরকম একটা ফিলিংস ।




একটু দূর যাওয়ার পর জাহাজ থেমে গেল । ঘটনা কি? ঘটনা হচ্ছে কিছু পর্যটক রেখেই জাহাজ রওয়ানা দিয়েছে । এদেরকে ছাড়া জাহাজ যাবেনা । তাই যারা দেরি করেছে তাদেরকে স্পিডবোটে করে নিয়ে আসা হচ্ছে । সেই স্পিড বোট থেকে আবার জাহাজে তুলা হচ্ছে , সাগরের এই ঢেউ এর ভিতরে । ভয়ংকর দৃশ্য । এরমধ্যে দেখলাম একজন এক হাতে বাচ্চা কোলে নিয়ে আরেক হাত দিয়ে রেলিং বেয়ে বেয়ে জাহাজে উঠছেন । আতংকে আমার দমবন্ধ হয়ে গেল । জীবনে যদি কোন ভাল কাজ করি তবে আজকে সময় মত জাহাজে আসা হল সেই ঘটনা । 
.
জাহাজের ডেকে গিয়ে দাড়ালাম। নাবিক একটু বয়স্ক । দেখে একটু সাহস পেলাম । এক্সপিরিয়েন্সড লোক বোঝা যাচ্ছে।  যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই ধমক দিচ্ছে ! এই সব লোকের কাছে ধমক খেতেও ভাল লাগে , বুঝা যায় যে এরা খুব পাকা লোক , বিপদের সম্ভাবনা কম । হাতে হ্যান্ড মাইক, মাঝে মাঝে হ্যান্ড মাইকেও ধমক দিচ্ছে। আমি ভুল করে একবার উনার গ্লাসের সামনে (জাহাজের একেবারে সামনে) চলে গিয়েছিলাম,  গ্লাসের ভেতর থেকে ধমক দেওয়া যাবেনা বলেই মনে হয় উনি জাহাজের হর্ন বাজালেন। বিকট আওয়াজ।  গায়ে গরম পানি পড়লে মানুষ যেমন লাফ দেয়, তেমন একটা লাফ দিলাম। দুই একজন মুখ চেপে হাসল ।  আরে বড় বড় জাহাজে এ সব ছোট ছোট ব্যপার ঘটে , ব্যাপার না !

সাগর যাত্রার শুরু ভালই ছিল । হালকা বাতাস, ঢেউ এর দোল আর এক পাশে কক্সবাজারের সৈকত । অন্যপাশে অথৈ সাগর যার নেই কোন কুল কিনারা । অদ্ভুত রোমাঞ্চ ।  উপরে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা । পতপত করে ।

ঘন্টাখানেক পর আবিস্কার করলাম সাগরে আসলে ঢেউ দেখা ছাড়া করার  আর তেমন  কিছুই নাই। একি ঘটনা, কোন ঢেউ বড় কোনটা ছোট। আসছে , যাচ্ছে ।  কোথাও পড়েছিলাম মাসের পর মাস যারা জাহাজে থাকে, দিনের পর দিন একই রঙ একই ঘটনা দেখতে দেখতে  একসময় তারা মানসিক ভারসাম্য কিছুটা হারিয়ে ফেলে। অবশ্য সবাই না।

ঘন্টাখানেক পর জাহাজ থেকে নাস্তা দিল। মুহুর্ততেই ক্যান্টিনের সামনে বিশাল লাইন। সমগ্র জাহাজের সবাই সব বাদ দিয়ে এক লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। নাস্তা হচ্ছে প্যাটিস ,  ব্রেড আর পানি।  প্যাটিস আগের দিন রাতে বানানো।  এমনিতেই আমরা না খাওয়া,  এই প্যাটিস পেটে বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড তৈরি করে দিল, সাথে সাথেই শুরু গ্যাস সঞ্চালন, টক ঢেকুর! শুধু আমি না সমগ্র জাহাজের সবার । 

জাহাজের দুলুনি আর রোদে এমনিতেই শরীর একটু দূর্বল থাকে,  আবার সকাল উঠতে হয় বলে অনেকেই আগের রাত ঠিক মত ঘুমাতে পারেনি ।  এতসব ঘটনার মধ্যে গ্যাস্ট্রিক সমৃদ্ধ খাবারে বমি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই সাবধান। যাদের বমির সমস্যা হয় তারা অবশ্যই প্রস্তুতি নিয়ে উঠবেন।  আমার মত ভুল করবেন না । একটা প্যাটিস খেয়ে আমার মরার মত অবস্থা !

চাইলে জাহাজ ছাড়ার একঘন্টা পর একটু ঘুমিয়ে নিতে পারেন বা রেস্ট নিলেও ভাল,  জাহাজ ছাড়ার ৩-৪ ঘন্টা পর যখন টেকনাফের পাহাড়ের পাশ দিয়ে জাহাজ যায় সেটা বেশ দেখার মত দৃশ্য।  হুট করে মনে হয় হলিউডের কোন সিনেমা। সাথে যদি একটু বৃষ্টি পেয়ে যান তো পোয়াবারো। সবুজ পাহাড় তখন আরও সবুজ দেখা যায়। আমরা যেদিন যাই সেদিন ব্রিস্টি হচ্ছিল , ছিল বড় বড় ঢেউ , সাগরের রঙ মুহূর্তে হয়ে গেল অন্যরকম নীল । সেই জাহাজে ছিল না কোন নাস্তিক । সবাই ভাবছিল , আল্লাহ , সুন্দরমত দ্বিপে পৌঁছে দাও ! 



bay of bengal

টেকনাফের পাহাড় পেরোলেই আবছা আবছা সেন্ট মার্টিন্স দেখা যায়।  যারা প্রথম বার যায় তাদের জন্য অনেক রোমাঞ্চকর এক দৃশ্য। যদিও দেখে মনে আর আধাঘন্টা জাহাজ চললেই পৌছে যাব,  কিন্তু প্রায় এক থেকে দেড় ঘন্টা সময় লাগে। অবশ্য আবহাওয়া খারাপ থাকলে জাহাজ একটু ধীরে চলে । সব মিলিয়ে কক্সবাজার থেকে সেন্ট মারটীন্স পৌছাতে প্রায় ৬ থেকে ৭ ঘন্টা লাগবে । কপাল আর আবহাওয়া ভাল থাকলে ৫ ঘন্টা ।

কক্সবাজার থেকে ছেড়ে যাওয়া এই কর্ণফুলী জাহাজ এর ধারন ক্ষমতা প্রায় ৬০০ জন । ৪ নম্বর বিপদ সংকেতেও যাতে টিকতে পারে এমন করেই বানানো হয়েছে কর্ণফুলীকে । জাহাজের দুলুনিতে যাদের সমস্যা হয় তারা জাহাজের মাঝামাঝি কোথাও বসে থাকলে দুলুনি কম টের পাবেন । যারা ধুমপান করেন তাদের জন্য দুঃসংবাদ, সাথে সিগারেট না থাকলে জাহাজের ক্যান্টিনে পাওয়া দুষ্কর । পেলেও প্রায় দ্বিগুণ খরচ হবে । 


saintmarin


জোয়ার ভাটার কারনে জাহাজ ছাড়ার সময় নিয়মিত চেঞ্জ হয় তাই জাহাজ থেক যখন সেন্টমারটিন্স নামবেন তখন ফেরার শিডিউল টা ভাল করে জেনে নিবেন ।

ওভারঅল টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার চাইতে কক্সবাজার থেকে কর্নফুলিতে যাওয়া বেশি রোমাঞ্চকর।  আবার ফেরার সময় রাতের অন্ধকারে বেশ ভাল একটা ফিল পাবেন। 

গলা ভাল থাকলে মন খুলে গাইতেই পারেন, ওরে নীল দরিয়া...'





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ