শ্রীলঙ্কার ট্রেন, রুট প্ল্যান , টিকেটিং ও যাত্রাপথের রোমাঞ্চ !

বলা হয়ে থাকে সুইজারল্যান্ড এর পর সবচাইতে আকর্ষণীয় ট্রেন রুট এখানে শ্রীলংকাতে । শ্রীলংকা ট্যুরে গিয়ে ট্রেন না চড়লে আসলে ট্যুরের আসল মজা পাওয়া যাবেনা ।


শ্রীলংকার ট্রেন ভ্রমন কেন বিখ্যাত?


প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের এক দারুন সংমিশ্রন শ্রীলংকার এই ট্রেন জার্নিতে । কি নেই এই রুটে? সাগর , বিশাল পাহাড়, ঝর্না , চা বাগান , টেম্পল , টানেল একের মধ্যে সব । আর বিশাল এই রেল নেটওয়ার্ক এবং এখানকার স্টেশন গুলো বহন করে চলে ব্রিটিশ স্থাপনার নিদর্শন ।  মজার বিষয় হচ্ছে এই পুরাতন স্টেশন গুলোকে তারা অনেক সুন্দর করে রেখেছে এবং প্রায় প্রতিটা স্টেশন একটা পার্ক এর মত ।


এখানে এসে ট্রেন চড়লে লাভ দুইটা , এক, অনেক খরচ বাচে এবং এই জার্নিটাই একটা দারুন অভিজ্ঞতা । এই ট্রেনে ট্রেনেই আমরা ঘুরেছি শ্রীলঙ্কার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত । একে একে দেখেছি ৫ টি বড় শহর । আজকের ব্লগে থাকল সেই ভ্রমন অভজ্ঞিতা , ট্রেনের তথ্য এবং বিভিন্ন টিপস ও ট্রিকস । শ্রীলংকা ট্যুরের আগে এই ব্লগ হয়ত আপনার ভ্রমন অভিজ্ঞতা আরও সুন্দর করে তুলবে ।


srilanka train




কিভাবে ট্রেনে ট্রেনে ট্রাভেল করবেন পুরো দেশ?


শ্রীলঙ্কা গিয়ে আমরা ট্রাভেল করেছিলাম কলম্বো থেকে গল , এলা থেকে নুয়ারা এলা , নুয়ারা এলা থেকে ক্যান্ডি , ক্যান্ডি থেকে কলম্বো । প্রতিটা রুটই একেক রকম সুন্দর । আপনি চাইলে কলম্বো থেকে যাত্রা শুরু করে ঘুরে এসে আবার কলম্বো চলে আসতে পারবেন । একই রুটে দুইবার ট্রাভেল করা লাগবে না । 


এই রুটকে আপনি দুই ভাবে যেতে পারেন,


১.  কলম্বো -> ক্যান্ডী -> নুয়ারা এলিয়া -> এলা -> গল -> কলম্বো


 (এলা থেকে গল এর অংশ আপনাকে বাসে করে আসতে হবে)


যদি এভাবে টিকেট না পাওয়া যায় তবে এই রুট কে উলটা করে,


২. কলম্বো -> গল -> এলা -> গলনুয়ারা এলিয়া -> ক্যান্ডী -> কলম্বো


এভাবে । ঘুরে ফিরে দুই রুটের দৃশ্য সমান। শ্রীলঙ্কাতে ট্রেন চড়লে খরচের পরিমান যেমন কমে তেমন সময় ও বাঁচে ।


ট্রেনের রুট , সময় সূচি এবং টিকেট কাটার পদ্ধতিঃ


কলম্বো থেকে গলঃ আরব সাগরের পাশ দিয়ে সমান্তরাল ভাবে চলা রেল লাইন । এই রুটের দূরত্ব মাত্র ৩ ঘন্টার । তবে প্রায় পুরোটা পথ জুড়ে এক পাশে সাগর দেখতে দেখতে যাবেন । এই রুটে সারাদিন অনেকগুলো ট্রেন চলে তাই আগে থেকে টিকেট কাটার প্রয়োজন নেই । স্টেশন গিয়ে টিকেট কেটে পরের ট্রেনে উঠে যেতে পারবেন । তবে ভিড় বেশি থাকলে বসার সিট পাওয়া কঠিন হয়ে যায় । কয়েকটি স্টেশন পর গিয়ে বসার জন্য সিট পাওয়া যায় । যেহেতু একপাশ ধরে সাগর তাই ট্রেনের ডান পাশে বসলে সাগর দেখতে পারবেন ভাল । 


srilanka train travel info




কলম্বো থেকে বাদুল্লা রুটঃ


কলম্বো থেকে বাদুল্লা রুট প্রায় ১১/১২ ঘন্টার । এই রুট শ্রীলংকার সবচাইতে বিচিত্র ট্রেন জার্নির অংশ । এই রুটের মধ্যে রয়েছে ক্যান্ডি , নুয়ারা এলা, এলা, বাদুল্লা । তাই বেশির ভাগ টুরিস্ট ছোট ছোট ভাগে এই ট্রেন জার্নি করে থাকেন ।


srilanka train inside
ট্রেনের থার্ড ক্লাসের ভেতরে


যদি আপনি টিকেট পেয়ে যান তবে , কলোম্বো থেকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে পারেন আর যদি না পান তবে কলম্বো থেকে গল হয়ে তারপর এলা গিয়ে উলটা রুট ধরে আসতে পারেন । এই রুটের ছোট ছোট ধাপের ব্যাপারে কিছু আইডিয়া দিচ্ছি ।


কলম্বো থেকে ক্যান্ডিঃ ক্যান্ডি শ্রিলংকার অন্যতম বড় শহরে যেখানে অনেক ঐতিহ্যের নিদর্শন রয়েছে । কলম্বো থেকে ক্যান্ডি রুটেও অনেক গুলো ট্রেন চলে যেগুলো সহজেই স্টেশন থেকে টিকেট কাটা যায়  । এই রুটের দৃশ্য অনেক বাংলাদেশের মত । তবে ক্যান্ডির কাছাকাছি এলে এলিফেন্ট রক দেখা যায় যেটা সিগ্রিয়াতে অবস্থিত ।


shrilanka train
ক্যান্ডি স্টেশনে এই ট্রেনে করেই গিয়েছিলাম কলম্বো


কলম্বো থেকে নুয়ারা এলা / এলা/ বাদুল্লাঃ নুয়ারা এলিয়ার স্টেশন নানু ওয়া নামে পরিচিত । এটি শহর হেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ।  এই রুটের টিকেটের চাহিদা অনেক বেশি থাকে । এবং এক দুই দিন আগে পাওয়া যায়না বললেই চলে । বাংলাদেশ থেকে কাটতে চাইলে আপনি দুই তিন সপ্তাহ আগে থেকে চেস্টা করা শুরু করতে হবে । ভাগ্য ভাল থাকলে পেয়ে যাবেন । অথবা স্টেশনে গিয়ে খোঁজ নিতে পারেন সেখানে বিদেশিদের জন্য আলাদা টিকেট কাটার ব্যাবস্থা রয়েছে ।


train of shrilnak
ক্রসিং এর সময় দুই ট্রেন একসাথে

রুট টাকে যদি উলটা করে আসেন তবে,


এলা থেকে নুয়ারা এলিয়াঃ এই রুটে পাবেন উচু পাহাড় , চা বাগান , ঝর্না । এটাই সবচাইতে আকর্ষণীয় রুট । এখানে ট্রেন আস্তে আস্তে ট্রেন উঠে যায় ৬০০০ ফুট উচ্চতায় । ৬০০০ ফুট মানে এভারেস্ট এর ৫ ভাগের ১ ভাগ । এই রুটের স্টেশন গুলো সব ছবির মত সুন্দর । এই ট্রেনের টিকেট ওয়েব এ এভেইলেবল থাকে । টিকেট কাটার সময় মাথায় রাখবেন আপনার ট্রাভেলিং টাইম টা যাতে দুপুর হয় , এসময় আপনি বেস্ট ভিউ পাবেন ।


আপনি চাইলে আপনার যাত্রা বাদুল্লা থেকেও শুরু করতে পারেন । তবে এক্ষেত্রে আপনি এলা স্টেশনের সৌন্দর্য মিস করবেন । এলা স্টেশন ব্রিটিশ আমলে নির্মিত চমৎকার সাজানো গোছানো একটা স্টেশন । এলা থেকে বাদুল্লা দুইটা খুবই কাছাকাছি স্টেশন । এই রুটের দুইটা আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে নাইন আর্চ ব্রিজ এবং ডামাডোলা স্টেশন । নাইন আর্চ ব্রিজ শ্রীলংকাতে খুবই জনপ্রিয় এবং একে জনপ্রিয়তার কারনে শ্রিলংকার আইফেল টাওয়ার এর সাথে তুলনা করা যায় । কারন এটা না দেখে ট্যুরিস্টরা শ্রীলঙ্কা থেকে ফেরেন না । এলা থেকে বাদুল্লা বা বাদুল্লা থেকে এলা আসার পথে এই ট্রেন নাইন আর্চ ব্রিজ পারি দেয় । এর পর রয়েছে ডামাডোলা স্টেশন । এটা শ্রীলংকার রেল ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটা চমৎকার দৃশ্য । কারন ট্রেন এখানে এসে আবার এই স্টেশনের নিচ দিয়ে যাওয়া টানেলের ভেতর দিয়ে চলে যায় । 

nine arch bridge
এই রুটের বিখ্যাত নাইন আর্চ ব্রিজ


শ্রীলংকার রেল টিকেটিং এর ওয়েব সাইটে নাইন আর্চ ব্রিজ এর ছবি দেয়া রয়েছে , যেটাকে শ্রীলংকার রেলের আইকনিক পিকচার হিসেবে বলা হয় ।


নাইন আর্চ ব্রিজ যে শুধু মাত্র ট্রেন চড়লেই দেখা যায় এমন না । আপনি এলা গিয়েও এটি দেখতে পারবেন । যাওয়ার আগে ট্রেন যাওয়া আসার শিডিউল জেনে গেলে চমৎকার কিছু দৃশ্য পাবেন ।


এই রুট ধরে যেতে যেতে আপনি উঠে যাবেন ৬০০০ ফুট উচ্চতায় । এই উচ্চতায় একটি স্টেশন ও রয়েছে । এই সময় ট্রেনের ধারে বিশাল সব পাহাড়ি খাদ দেখা যায় । এই দৃশ্য এত সুন্দর যে আজীবন মনে রাখার মত । যেতে যেতে রুট জুড়ে রয়েছে অসংখ্য টানেল । এই রুটেই রয়েছে ৫৬২ মিটার দীর্ঘ এক টানেল যেটা পারি দিতে প্রায় ১-১.৫ মিনিট সময় প্রয়োজন হয় ।


নুয়ারা এলিয়া থেকে ক্যান্ডি - কলম্বোঃ এই রুটের প্রধান আকর্ষণ চা বাগান এবং ছোট বড় সব পাহাড় । এখানের চা বাগান গুলো খুবই সুন্দর । যেতে যেতে কিছু টেমপল এর দেখাও পাবেন ।


নুয়ারা এলিয়াতে পুরোনো দিনের স্টাইলে ট্রেনের সময়সূচি


শ্রীলংকার বাইরে থেকে টিকেট কাটার উপায়ঃ


শ্রীলংকার রেল টীকেটীং এর ওয়েব এড্রেসঃ https://seatreservation.railway.gov.lk/mtktwebslr/


srilanka railway ticket ella to nanu oya
ছবিঃ এলা থেকে নুয়ারা এলিয়ার ট্রেন টিকেটের অনলাইন কপি



যদি রেলে সরাসরি টিকেট না পান , তবে ট্যুর অপারেটরদের ওয়েবসাইট চেক করে দেখতে পারেন , যদিও তাদের সাইটে টিকেটের প্রাইস কিছুটা বেশি হয় । এরকম একটা ওয়েবসাইট হচ্ছে: www.bookaway.com


আমরা এই সাইট থেকে টিকেট কেটে ছিলাম , তবে তারা টিকেট দিতে না পারায় শেষ মুহুরতে টিকেট এর টাকা রিফান্ড করে দেয় । পরবর্তিতে শ্রিলংকাতে গিয়ে ফোরট স্টেশনে গিয়ে আমরা নুয়ারা এলিয়া থেকে কলোম্ব এর টীকেট কাটি এবং এলা থেকে নুয়ারা এলিয়ার টিকেট কাটি অনলাইনে । আর কলম্বো থেকে গলের টিকেট স্টেশনে এসে সরাসরি কেটে তারপর ট্রেনে উঠি ।





আমার কাছে বেস্ট রুট কোনটাঃ


আমার কাছে বেস্ট রুট ছিল দুইটা । এক, এলা থেকে নুয়ারা এলিয়া এবং কলম্বো থেকে গল । অন্য কোন রুট ম্যানেজ করতে না পারলেও এই দুইটা রুট আপনাকে মাস্ট ট্রাই করতে হবে ।


কোন ধরনের সিট নিবেন? ভাড়া কেমনঃ


শ্রীলঙ্কাতে ট্রেন ভাড়া অনেক কম ।  যদি গরম কম থাকে বা নভেম্বর থেকে মার্চ এর ভিতরে ট্রাভেল করেন, তবে চেস্টা করবেন নন এসি থার্ড ক্লাসে জার্নি করার জন্য, এতে আপনার খরচ যেমন কমবে তেমনি জানালা বা দরজার বাইরে দৃশ্য উপোভোগ করতে পারবেন বেশি । বিভিন্ন রুটের ভাড়ার একটা ধারনা থাকল এখানে,


কলম্বো থেকে গলঃ ২০০ টাকা জন প্রতি

কলম্বো থেকে ক্যান্ডিঃ ৩০০ টাকা জন প্রতি (থার্ড ক্লাস)

কলম্বো থেকে ক্যান্ডি হয়ে নুয়ারা এলিয়াঃ থার্ড ক্লাস নন এসি ৫০০ টাকা জন প্রতি ।

নুয়ারা এলিয়া থেকে এলাঃ থার্ড ক্লাস নন এসি ৮৫০ টাকা জনপ্রতি ।


ওয়াশরুম ও খাবারের ফ্যাসিলিটি কেমনঃ 


নতুন যে ট্রেনগুলো রয়েছে সেগুলোতে ওয়াশরুম ও খাবারের ফ্যাসিলিটি অনেক ভাল । তবে কলম্বো থেকে গল যাওয়ার ট্রেন গুলো একটু পুরাতন তাই এগুলোতে আপনি এত ভাল সুবিধা পাবেন না । 


শ্রীলঙ্কাতে এই ট্রেন জার্নিতে আরও ভাল লেগেছে ট্রেন স্টেশনের নামগুলো , হাপুতালি, আলুদগামা এই নামগুলো এখনও কানে বাজে ।


আশা করছি ভাল লেগেছে এই ব্লগ । কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না । আর আমাদের ইউটিউব  ভিডিও দেখার আমন্ত্রন রইল । 





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ