ইন্ডিগো এয়ারলাইন্স এ ঢাকা থেকে কলম্বো যাত্রা !

প্লেন জিনিসটাই এমন, দূর থেকেই দেখতে ভাল লাগে। কাছে গিয়ে উঠতে গেলে ভয় হয়।  এত বড় ভারী একটা লোহার জিনিস আকাশে ঘন্টার পর ঘন্টা ভেসে থাকে সেটা চিন্তা করলেই আমার প্লেনে উঠার ইচ্ছা চলে যায়। 

শ্রীলংকা একটা ল্যান্ডলক কান্ট্রি। মানে এর চতুরপাশে সাগর । সাধারনত এখানে প্লেন যাওয়া ছাড়া যাওয়ার উপায় ও নেই ( চেন্নাই থেকে সম্ভবত জাহাজ যায়, যেটা এক্সপেন্সিভ ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার) । এখন পর্যন্ত একমাত্র ভারতই একমাত্র দেশে যেখানে আমরা ট্যুরিস্ট হিসেবে বাই রোড  যেতে পারি, বাকি সব দেশেই যেতে লাগবে প্লেন।  

তাও যাব ইন্ডিগো এয়ারলাইন্স এ।  জেনে রাখা ভাল পৃথিবীর সবচাইতে খারাপ এয়ারলাইন্স সার্ভিসের একটি হচ্ছে এই ইন্ডিগো এয়ারলাইন্স । ভাই, আমার কথা হচ্ছে, সার্ভিস হোক যেমন তেমন,  কিন্তু পাইলট হোক ভাল ।  ভেতরে যাত্রিদের পিটাক,  মারুক যা খুশি করুক! ঠিক মত ল্যান্ড করতে পারলেই হয় !

indigo dhaka colombo airbus 320



যাত্রা শুরু

আমাদের প্লেন ছিল এয়ারবাস - ৩২০ মডেল । ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের প্রচুর প্লেন রয়েছে এই মডেলের।  আমরা যখন চেন্নাই তে ট্রাঞ্জিটের জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন প্রায় প্রতি ৫ মিনিটে একটা করে ইন্ডিগোর এয়ারবাস ৩২০ বিমান উঠছিল আর নামছিল । মনে হচ্ছিল ঢাকার দ্যা গ্রান্ড তুরাগ বাস ।

প্লেন ছাড়বে ঢাকা এয়ারপরট থেকে ৫ টা ২০ এ।  আমরা নিয়ম মেনে ৩-৪ ঘন্টা আগেই এসেছি।  এত আগে না আসলে বিপদে পরার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এয়ারলাইন্স বোর্ডিং , পুলিশ ইমিগ্রেশনের অনেক খুটিনাটি ঝামেলা আছে।  আমরা নিজেরাও ইমিগ্রেশনের ঝামেলায় পরে প্রায় ২ ঘন্টা নষ্ট করেছি । এখানে করেছি বললে ভুল হবে , বলা উচিত 'করেছে' । কারন আমাদের সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল ।

টিকেট করেছি Sharetrip.com এর  ওয়েবসাইট থেকে । ক্রেডিট কার্ডে অফার ছিল তাই কিছুটা কম পড়েছে ।

indigo airlines airbus 320
ছবিঃ এই প্লেনেই আমরা যাব ঢাকা থেকে


প্লেনের ভিতর বসার ব্যবস্থা মোটামুটিভাবে কঞ্জাস্টেড। যেহেতু ইন্ডিগো সস্তা ভাড়ায়  ফ্লাইট সার্ভিসে বিশ্বাসী,  তাই তারা কম জায়গায় কম টাকায় বেশি লোক নেয়ার চেস্টা করবে সেটাই স্বাভাবিক।  তাই এটাকে আমরা খারাপ ভাবে নিলাম না।  খারাপ ভাবে নিলাম, আমাদের চা কফি কিছুই দিল না। যদিও ট্রেতে করে ভিতরে তারা ঠিকই চা কফি বিক্রি করে বেরাচ্ছে।  এক কাপ কফি ২০০ রুপি,  বাংলাদেশি টাকায় ৩০০। আমাদের বাংলাদেশ বিমান এ ঢাকা থেকে সিলেট যেতেই স্যান্ডুইচ দেয়। ভাল দিক হচ্ছে, এইটা খেতে খেতেই ৫ মিনিট প্লেনের কথা ভুলে থাকা যায়।  ওরা কিছুই দিল না।  দিল শুধু একটা ম্যাগাজিন।  

২০১৫ সালে প্রথম যখন প্লেন চড়ি,  তখন খুব ভয় হচ্ছিল,  যদি ধুম করে নিচে পরে যায়?  তখন আমার পাশের সিটের এক ভদ্রলোক রিলাক্সে ম্যাগাজিন পড়ছিল। মাঝ আকাশে বড় দুই তিনটা ঝাকুনির পরেও তার ম্যাগাজিন পড়া থামেনি । সেদিন এটা  দেখে খুব শান্তি পেয়েছিলাম।  না তেমন ভয়ের কিছু নেই, ভয়ের কিছু হলে এই লোক এত আয়েশ করে ম্যাগাজিন পরত না ।  তারমানে এই লক প্রায়ই প্লেনে যাওয়া আশা করে।  আমিও তাই ভাব নেয়ার জন্য ম্যাগাজিন হাতে নিলাম । জেনে রাখা ভাল দুর্ঘটনার বিচারে পৃথিবীর সবচাইতে সেফ বাহন হচ্ছে প্লেন । প্রতি ১ কোটি ফ্লাইটে মাত্র একটি দুর্ঘটনা ঘটে !

যাই হোক ফিরে আসি আমাদের ফ্লাইটে । তখন সন্ধ্যার সময়। প্লেনের বাইরে দিয়ে নীল আর কমলা রঙ এর গ্রাডিয়ান্ট একটা রঙ দেখা যাচ্ছে, অদ্ভুত, রহস্যময় কেমন যেন অপার্থিব। ভাবছি নিচের পৃথিবীতে সবাই হেটে বেড়াচ্ছে আমরা সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কয়েক মাইল উপর দিয়ে আকাশে ভেসে বেরাচ্ছি!  নাহ,  এসব ভুলে থাকতে আবার ম্যাগাজিন নিতে হবে !  উল্টা পালটা ভাবা যাবেনা ! 

Indigo airbus 320
ছবিঃ বাইরের রোদ পরছে মুখে


চেন্নাইতে বিরতি

কলোম্ব যেতে যেতে আমাদের প্লেন থামবে চেন্নাই তে।  সেখানে ৯ ঘন্টার ট্রাঞ্জিট । এই সময়টাতে আমাদের বসে থাকতে হবে এয়ারপোর্ট এর একটা নির্দিষ্ট স্থানে ।  ভারতের ভিসা থাকলেও বের হতে পারবেন না।  সমস্যা হচ্ছে এখানে এয়ারপোর্ট এ এই অবস্থায় খাওয়া দাওয়ার কন ভাল ব্যবস্থা নেই। ফোন দিয়ে দিয়ে খাবার অর্ডার করতে হয়,  দাম অনেক বেশি, ইচ্ছা হলে খাবার দেয় না হয় আসে না।  এই হচ্ছে অবস্থা । নিজেদের শরনারথি মনে হছে । যেখান আছি সেখানে শক্ত কিছু স্টিল এর চেয়ার।  ওয়াই ফাই নেই, মোবাইল নেট নেই,  কি একটা খারাপ অবস্থা ।  অন্তত ওয়াইফাই আর ছোট একটা খাবারের দোকান থাকলে এত কস্ট করা লাগত না (এই দুটি সুবিধাই আছে কিন্তু ব্যাবহারের পারমিশন নেই, কেন নেই জানিনা, শুনেছি কয়েক মাস আগে কয়েকজন বাংলাদেশি কোন একটা সমস্যা করেছিল) । 

chennai airport
ছবিঃ বাধ্য হয়ে মাটিতে শুয়ে থাকা !



রাতে ক্লান্ত হয়ে না পারতে মাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম কিছু সময়।  সকালে উঠে আবার ফ্লাইটের অপেক্ষা।  তবে এর মধ্যে আবার কিছু ভাল সময় কেটেছে,  গ্লাসের বাইরে একটার পর একটা প্লেন উঠা নামার দৃশ্যে। কিন্তু পেটে ঠিকমত খাবার না থাকলে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর দৃশ্যগুলোও অর্থহীন ।

chennai airport runway
ছবিঃ এখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় প্লেন উঠা নামা


অপেক্ষা অপেক্ষা এবং অপেক্ষা

চেন্নাই থেকে আমাদের ফ্লাইট ১১ টায় । এয়ারপোর্টে এর মনিটরে আমাদের ফ্লাইট এর বোর্ডিং  দিয়ে দিয়েছে আমরা অপেক্ষা করছি কখন আমাদের ডাকবে,  এই অসহ্য বন্দি দশা থেকে এটলিস্ট প্লেনে উঠে বসে থাকলেও শান্তি। অন্তত সুন্দরি এয়ার হস্টেসরা ফেক একটা মুচকি হাসি দেয় । 

ফ্লাইট ১১ টায় কিন্তু ১০ টা বেজে গেলেও ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের কেউ আসল না আমাদের ডাকতে, এখানে আমরা আছি প্রায় ৩০-৪০ জন যাত্রি, এদের কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স এইতো ১ ঘন্টা লাগবে ।  কিছুই বুঝতে পারছিনা। এদিকে মনিটরে দেখাচ্ছে কলোম্বগামি ইন্ডীগো এয়ারলাইন্স আছে  'ফাইনাল কল' এ, সাধারনত  এর কিছু সময় পর গেট লক করে প্লেন ফ্লাই করে। 

এমন সময় দুই জন ইন্ডিগো এর কর্মী হেটে যাচ্ছে দেখে আমরা তাদের ডাক দেই।  তারা শুনে অবাক হয়ে যায় যে আমাদের ডাকা হয়নি এখনো । তখন তড়িঘরি করে শুরু হল কার্যক্রম । শুরু হোল চেকিং , সময় স্বল্পতায় সে এক দেখার মত দৃশ্য , যে যেভাবে পারছে দৌড়াচ্ছে । পরবর্তীতে প্লেনের টাইম প্রায় ১ ঘন্টা দেরি করে ফ্লাইট টাইম পিছিয়ে দিল।  সেই ফ্লাইটে আদর করে আমাদের এক কাপ পানি দিল। আমরা ধন্য হলাম পানি পেয়ে।  

plane on the sky
ছবিঃ কলম্বো যাওয়ার সময় মেঘের উপর প্ল্যান



করে বিলম্বো নামছি কলম্বো

ভেবেছিলাম কলম্বো যেতে যেতে সাগর দেখতে দেখতে যাব।  কিন্তু তা আর হলনা। কলম্বতে সেদিন বৃষ্টি ,  মেঘের মধ্যে দিয়ে প্লেন নামল কলোম্ব তে। এয়ারপোর্ট এ নামার আগে দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল সারি সারি নারিকেল গাছ আর সাগর । বৃষ্টি , নারিকেল গাছ, প্লেন আর সাগর এই সময়টা মনে থাকবে আজীবন । এই সব সময় মনে হয় ইশ এই মুহুরতে দৃশ্যটা যদি আমার পরিবারের সবাইকে নিয়ে উপোভোগ করতে পারতাম !

srilanka Airport
ছবিঃ কলম্বোতে নামার পর এয়ারপোর্ট এ

শুনেছিলাম এয়ারলাইন্স এ বোর্ডিং এর সময় নাকি কত ডলার সাথে আছে চেক করে , ডলার কম পেলে ফেরত পাঠিয়ে দেয় । এই নিয়ে ভয় পেয়েছিলাম , আমি গরীব মানুষ সাথে ডলার কম । না জানি আবার চেক করে ফেরত পাঠিয়ে দেয় কিনা । তবে তেমন কিছুই ঘটে নি । আর এরকম ঘটনা খুবই রেয়ার ।

ফেরার সময় এর  অনাকাংকিত ঘটনা

ফেরার সময় ও আমাদের ফ্লাইট ছিল ইন্ডীগো এয়ারলাইন্সে । একইভাবে কানেক্টীং কলম্বো থেকে চেন্নাই তারপর ঢাকা । মোটামুটি সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল । তবে ফ্লাইট যখন ল্যান্ড করে তখন রানওয়েতে চাকা স্পর্শ করার সাথে সাথেই সবাই ধাক্কাধাক্কি করছিল ব্যাগ নামানো নিয়ে । এয়ার হস্টেস তখন শান্ত থাকার অনুরোধ করলে সিংগাপুর থেকে আসা এক প্রবাসী শ্রমিক সেই ভারতিয় এয়ার হোস্টেসকে ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য পৃথিবীর নিকৃষ্ট গালি দিয়ে বসেন । তার একমাত্র অপরাধ তিনি ভারতীয় । গালি শুনে এয়ার হস্টেস কিছু বললেন না তবে তার চোখ দিয়ে পানি চলে আসল । তারা যখন বুঝতে পারলেন যে কথা বলে আর লাভ হবে না তখন চুপচাপ গিয়ে এক কোনাতে দাঁড়িয়ে থাকলেন । কান্নায় তাদের চোখ ছল ছল করছে । 

নিজের দেশের মানুষের এমন ব্যবহারে অসহায় মনে হল । যে গালি দিয়েছে তাকে প্লেনের ভেতরে শাসিয়ে দিয়ে এলাম রাগের মাথায় আর সরি বলে এলাম এয়ার হোস্টেসকে । এই ঘটনায় প্লেন থেকে নামার কয়েক ঘন্টা পরেও মনটা খারাপ ছিল ।

আমাদের এই প্লেন যাত্রা নিয়ে আমার ইউটিউব ভিডিও দেখতে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংক এঃ


আশা করি ভাল লেগেছে । পাশে থাকার আমন্ত্রন রইল । 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ