ট্রেনে ট্রেনে কি সিলেট থেকেই বিরিশিরি যাওয়া যাবে? যদি যায় তাহলে কত সময় লাগে বা খরচ কত? এইসব প্রশ্নের আগ্রহ যাদের মাথায় আজকের এই পোস্ট তাদের জন্য । হয়ত জেনে আরও খুশি হবেন , ৩৫০ কিলোমিটার এই পথ পাড়ি দিতে আমার খরচ হয়েছে মাত্র ৩৭০ টাকা । তবে কস্ট একটাই ট্রেন বদল করতে হয়েছে দুই বার । তবে আমার মত ট্রেন পাগল মানুষের জন্য এগুলো তেমন কোন ব্যপার না । ট্রেন মানেই আমার কাছে ভালবাসা ।
চাইলে আপনি বাসে করে সিলেট থেকে সরাসরি দুরগাপুর বা কলমাকান্দা চলে যেতে পারবেন । তবে আমার ইচ্ছা ছিল ভৈরব থেকে দুরগাপুর পর্যন্ত ট্রেনের নতুন রুটটা এক্সপ্লোর করা । সম্পূর্ণ এই পথ পাড়ি দিতে আপনার সময় লাগবে ১১-১৫ ঘন্টার মত । যেহেতু ট্রেনের জার্নি অনেক আরামদায়ক এবং সাশ্রয়ী তাই সময়ের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দিলে নিঃসন্দেহে আপনি উপভোগ করবেন এই যাত্রা । তবে অবশ্যই টিকেট আগে থেকেই ম্যানেজ করে রাখতে হবে ।
আগেই বলেছি আমি একজন ট্রেনপাগল ভ্রমণপ্রেমী । ট্রেন দেখলে তাকিয়ে থাকি । সিলেট থেকে একেবারে দুরগাপুর যাওয়ার এই রুট টা খুজে খুজে বের করেছি রেলের টিকেটীং সাইট থেকে । যেহেতু সরাসরি ট্রেন নেই তাই কানেক্টিং ট্রেন ধরতে হবে । সেই কানেক্টিং রুটের ট্রেন ধরে আমি চলে যাব একদম সীমান্তঘেঁষা জনপদ ‘জারিয়া’ পর্যন্ত, যেখান থেকে বিরিশিরি মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে। আবার একই রুট ব্যাবহার করে আপনি চলে যেতে পারবেন কলমাকান্দার কাছাকাছি । সময় লাগবে একই ।
তাহলে আর দেরি কেন? চলুন শুরু করি ।
সিলেট থেকে যাত্রা শুরু
সিলেট থেকে সকালের প্রথম ট্রেন হচ্ছে কালনি এক্সপ্রেস । এটি ছাড়ে সকাল ৬ঃ১৫ তে । প্রথম লক্ষ্য ভৈরব জংশন । সকালের কালনি এক্সপ্রেসের যাত্রাটা খুব সুন্দর । সাত সকালে সবুজ প্রকৃতি আর চা বাগান দেখতে দেখতে মনটা ভাল হয়ে যায় । ভৈরব জংশন পর্যন্ত যেতে যেতে কালনি এক্সপ্রেসের সময় লাগবে ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘন্টা ।
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে ইদানিং শায়েস্তাগঞ্জ এর পর থেকেই স্ট্যান্ডিং বা বিনা টিকেটের যাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি । আমার এই ট্যুরে অবস্থা আরও খারাপ । উপায় না দেখে আমার সিটে বসিয়েছি দুইজন বাচ্চাকে । পিছনের সিটের মহিলা তার ব্যাগের ওজন নিতে না পেরে ব্যাগ রেখেছেন আমার কাঁধে , সেই লেভেলের একটা ট্রেন জার্নি । এর মধ্যে দুই তিন জন মহিলা কারন ছাড়াই একটু পর পর ঝগড়া করছেন । একজন আবার উঠেছে মাংসের ব্যাগ নিয়ে । সেই ব্যাগ দিয়ে চুয়ায়ে চুয়ায়ে পানি পরছে !
এইসব পরিস্থিতিএ তীব্র গরমে যাত্রীদের কস্ট হয় অনেক , এমনকি মহিলা যাত্রীরা উঠে ওয়াশরুমে যাওয়ার সুযোগ ও পাননা । এই রুটের পরিবেশের উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি।
নামলাম ভৈরব স্টেশনঃ
ঘড়িতে বাজে সাড়ে ১১ টা । মেঘনা নদীর ভৈরব সেতু পার হয়ে ট্রেন থামল ভৈরব স্টেশনে । ট্রেন থেকে এই স্টেশন অনেকবার দেখেছি । আজকে প্রথম নামলাম । সকালে কিছু খাওয়া হয়নি । স্টেশনের বাইরে গিয়ে নাস্তা করে এলাম । পাশেই মসজিদ আছে তাই চোখে মুখে একটু পানি দিয়ে ফ্রেস হয়ে গেলাম । এখন অপেক্ষা বিজয় এক্সপ্রেস এর জন্য । ভৈরব স্টেশন বেশ ব্যাস্ত একটা স্টেশন , ঢাকা - চিটাগাং , ঢাকা -সিলেট , চিটাগাং - জামালপুর, ঢাকা- কিশোরগঞ্জ এর ট্রেন চলে এই রুট ধরে । তাই একটু পরপর একটার পর একটা ট্রেন যাওয়া আসা করছে । খারাপ কি ? এই সময়ের ভেতর উপোভোগ করব বেশ কিছু ট্রেনের যাওয়া আসা যেমন চট্রগ্রামগামি জালালাবাদ, সিলেট গামি জয়ন্তিকা, কিশোরগঞ্জগামি কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস সহ বেশ কিছু ট্রেন ।
বিজয় এক্সপ্রেস ছেড়ে আসবে চট্রগ্রাম থেকে ,জানলাম, বিজয় এক্সপ্রেস লেট লতিফ, প্রতিদিনই দেরি করে আসে। আজকের ট্রেন আসার কথা ১টা ১৫-তে, এল ২টা ১০ মিনিটে। যাত্রা দেরিতে হলেও আনন্দ কিন্তু ঠিকই ছিল, কারণ এবার শুরু হচ্ছে একেবারে নতুন রুটে আমার ট্রেন অভিজ্ঞতা।
ভৈরব থেকে ময়মনসিংহ
যাই হক বিজয় এক্সপ্রেস এ করে বাকিপথ আমার জন্য একেবারে নতুন । আমার মত কাদের কাদের ট্রেনে করে নতুন দৃশ্য দেখা খুব পছন্দের ? কমেন্ট বক্সে জানিয়ে দিবেন । যদিও প্রচন্ড গরমের কারনে যদিও এই আনন্দ উপভগের মাত্রা কিছুটা কমে এসেছে , এরপর আমরা নামব হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসখ্যাত গৌরীপুর জংশনে। গৌরীপুর নামটিই এক নস্টালজিয়া—বাংলা সাহিত্যের এক অনুভূতির জায়গা।
পথে ট্রেন থামবে কিশোরগঞ্জে । ভৈরব থেকে গৌরীপুর পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে ৩ ঘন্টার কাছাকাছি । এই পথ যেতে যেতে প্রচুর সরিষা গাছ । সবুজ আর হলুদের অপূর্ব মিশ্রন । এই দেখতে দেখতেই ট্রেন চলে এল গৌরীপুর জংশন এ । এখানে এসে ট্রেন ইঞ্জিন এর দিক পরিবর্তন করে । মানে এক পাশ থেকে খুলে এনে আরেক পাশে যুক্ত হবে তারপর যাবে জামালপুরের দিকে ।
যারা হুমায়ুন আহমেদ এর উপন্যাস পড়েছেন তাদের জন্য নস্টালজিক এক ট্রেন হচ্ছে গৌরীপুর জংশন । তার অনেকগুলো উপন্যাসের অংশ আছে এখানে , এমনকি আস্ত এক উপন্যাস আছে যার নামই গৌরীপুর জংশন । সেই উপন্যাস এর একটা লাইন ছিল এরকম , ট্রেন দেখলেই জয়নালের কাছে যেতে ইচ্ছা হয় । জয়নাল এর সাথে নিজের মিল খুজে পেলাম । আমারও কেন জানি ট্রেন দেখলেই কাছে যেতে ইচ্ছা হয় ।
যাই হোক গৌরীপুর স্টেশনে কিছু সময় কাটিয়ে সেখান থেকে উঠব লোকাল ট্রেনে, সেই ট্রেনে করে চলে যাব জারিয়াতে , জারিয়ার পর আর ট্রেন লাইন নেই । তাই সেখানে নেমে অটো রিক্সা করে চলে যাব দুরগাপুর, বিরিশিরিতে ।
বলে রাখি আপনি যদি বিরিশিরি এর পরিবর্তে কলমাকান্দা যেতে চান , তবে জারিয়া এক্সপ্রেস এর বদলে আপনাকে উঠতে হবে নেত্রকোনাগামি মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে এবং নামতে হব ঠাকুরকোনা ।
জারিয়ার লোকাল ট্রেন এ উঠলাম , ট্রেন ভর্তি মানুষ , এবং মজার বিষয় হচ্ছে তাদের প্রায় সবাই টিকেট না কেটেই উঠেছে । এমনকি ট্রেনে টীকেট চেক করারও কোন উপায় নেই । তবে গর্বের বিষয় হচ্ছে আমরা কেটেছি , টিকেটের দাম ১০ টাকা । ১০ টাকাতে ৩২ কিলোমিটার পথ । এই যুগে এসে মারাত্নক ব্যাপার । এই ট্রেনে যারা সিট পেয়েছে তারা ভিআইপি । ভিআইপিদের চোখে মুখে উচ্ছ্বাস । আগামি ১ ঘন্টার জন্য তারা পৃথিবীর সবচাইতে এলিট শ্রেনির মানুষ । ট্রেন চলতে চলতে সন্ধ্যা গড়িয়ে এল । দূরে মেঘালয়ের পাহাড় উকি দেয়া শুরু করেছে । ট্রেনের ভিতর লাইট নেই, সন্ধ্যার পর ঘুটঘুটে অন্ধকার । চারিদকে গ্রাম গ্রাম পরিবেশ । কেমন জানি নেশা নেশা একটা পরিবেশ । রাত নামছে , সেই হাজার বছরের পরিচিত সেই রাত ।
এই রোমাঞকর ভ্রমনের ট্রেন জারনির কথা মনে থাকবে অনেক দিন । কোন প্রশ্ন থাকলে জানাতে ভুলবেন না । ধন্যবাদ ।
0 মন্তব্যসমূহ