চেন্নাই থেকে কলম্বো এর উদ্দ্যেশ্যে ইন্ডিগো এয়ারলাইন্স ফ্লাইট যখন আকাশে উড়ল তখন মনে মনে ভাবছিলাম প্লেন এত উপরে নেয়ার কি দরকার? আরেকটু নিচে দিয়ে গেলেই তো একটু গাছপালা সমুদ্র দেখে দেখে যেতে পারতাম!
আকাশে প্রচুর মেঘ । প্লেন সেই মেঘেরও উপর দিয়ে উড়ছে । সাদা সাদা মেঘ ছাড়া দেখার আর কিছুই নেই ।
কলম্বো নেমে আমার অনুভুতি হলো বাংলা সিনেমার সেই নায়কের মত, সেটা হচ্ছে ' তোমার সাথে কেন আমার আগে দেখা হলো না?'
জীবনে কেন এত দেরিতে কলম্বো এলাম? আগে কেন এলাম না?উত্তর খুজতে গিয়ে আবিস্কার করলাম, আগে আরো গরিব ছিলাম এই কারনে। এখনও গরীব আছি , তবে তুলনামুলক ভাল । তাই সস্তা ফ্লাইটের খোজে এসেছি ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সএ ১০-১১ ঘন্টার চেন্নাই যাত্রা বিরতি নিয়ে । শ্রীলঙ্কা এয়ারলাইন্স এ আসিনি কারন ভাড়া বেশি, প্রায় ৫৫ হাজার টাকা আপ ডাউন। আর ইন্ডিগো ৩৩ হাজার। ইদানিং আরেকটা ডিরেক্ট এয়ারলাইন্স চলে এই রুতে নাম ফিটজ , আগে কম পাওয়া যেত এখন ফ্লাইটের সংখ্যা বেশি , এরা কাছাকাছি রেটে ডিরেক্ট নিয়ে যায় । এর পরে আসলে ফিডজ দিয়েই আসব । ইন্ডিগো এয়ারলাইন্স এর দুঃসহ অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলাম আগের ব্লগে ।
শ্রীলঙ্কা মাত্র কয়েকদিন আগে দেউলিয়া হয়েছে । দক্ষিন এশিয়ার এই দেশটা যে খুব একটা উন্নত হবে না সেটা অনুমেয় । বিমানবন্দর দেখে সেটা আরো পরিস্কার হল। বাইরে থেকে দেখতে আমাদের সিলেট বা চট্রগ্রাম বিমানবন্দরের মত। এক লাইনে অনেক গুলো শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্স এর প্লেন দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে আহারে কত ভাল প্লেন , অনেকটা লোকাল বাস থেকে হানিফ শ্যামলীর গাড়ি দেখার মত ব্যাপার সেপার ।
চলে আসি কলম্বো বিমানবন্দরে। বিমানবন্দর অনেক পরিস্কার আর প্রচুর বিদেশি ট্যুরিস্ট । ইমিগ্রেশন শেষ করতে খুব বেশি সময় লাগল না । বিমানবন্দরে থাকতে থাক্তেই আমরা এয়ারপরট এর ওয়াইফাই ব্যাবহার করে পিক মি এপস এর মাধ্যমে টুকটুক ফোন দিলাম । এখানে সিএনজি অটোরিক্সাকে টুকটুক বলে । ভাড়া দেখাচ্ছে ২১০০ রুপি । মানে বাংলাদেশের টাকায় প্রায় ৮০০ টাকা । বিমানবন্দরের বাইরে সিম কিনার ব্যাবস্থা রয়েছে । কিছু ট্রাভেল এজেন্সিও আছে , তবে এদের থেকে ট্যুর বুক না করাই ভাল এরা চার্জ করে কিছুটা বেশি ।
শহরের দিকে যাত্রাঃ
বিমানবন্দর থেকে কলম্বো শহর প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে । এই দীর্ঘ পথে কোথাও কোন ট্রাফিক জ্যাম নেই । রাস্তা ভর্তি টুকটুক আর অশোক লেলেন্ড এর লম্বা বাসগুলো । চেন্নাই চেন্নাই একটা স্মেল পাওয়া যাচ্ছে ।
কলম্বোতে যেয়ে আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে স্টেশন যাওয়া । আগামি কয়েকদিনের ট্রেনের টিকেট কাটতে হবে । ট্রেন এর টীকেট পাওয়ার উপর নির্ভর করছে আমাদের বাকি দিনের প্ল্যান গুলো । বাংলাদেশ থেকে টিকেটের অনেক চেস্টা করেছি কিন্তু পাইনি । অতিরিক্ত ডিমান্ড এর কারনে রুটের ট্রেনের টিকেট আগেই সেল হয়ে যায় । কিনতে হয় ব্ল্যাকে ।
চলে এলাম রেলস্টেশনঃ
১ ঘন্টায় চলে এলাম কলম্ব এর ফোরট স্টেশনে । এটা শ্রীলঙ্কার ‘কমলাপুর রেল স্টেশন’ । স্টেশন টা ব্রিটিশ আমলের । স্ট্রাকচার আগের মতই পুরাতন রয়ে গিয়েছে । শুধু রঙ করা হয়েছে । একটার পর একটা ট্রেন আসছে । টিকেট কাউন্টারের ভেতরও ব্রিটিশ আমলের ঘর । একটা ক্লাসিক ফিলিংস । বিদেশিদের জন্য আলাদা কাউন্টার । নিজেকে বিদেশি ভাবতে ভালই লাগছে । বিদেশি বিদেশি ভাব নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম আগামিকালের নুয়ারা এলিয়ার টিকেট হবে কি না? উত্তর এল “নেই” । কিন্তু ট্রেন তো আমার লাগবেই লাগবে ।
টিকেট কই?
আমাদের প্ল্যান ছিল কলম্বো থেকে ক্যান্ডী হয়ে নুয়ারা এলিয়া তারপর এলা যাব । সেখান থেকে মিরিসা তারপর গল হয়ে কলম্বতে ফেরত । কিন্তু এই রুটের কোন টিকেট নেই । কথায় আছে বুদ্ধি থাকলে ঘরজামাই থাকতে হয় না । বুদ্ধি করে রুট প্ল্যানটাকে উলটে ফেললাম । প্রথমে যাব গল , তারপর যাব মিরিসা সেখান থেকে এলা হয়ে ক্যান্ডি - কলম্বো । ঘুরে ফিরে তো দৃশ্য একই । ট্রেন আমাকে চড়তেই হবে শ্রীলংকা এসে । এনিহাও !
গল ফেস গ্রিনঃ
উলটা রুটের ট্রেনের টিকেট নিয়ে শহর দেখতে দেখতে চলে গেলাম গল ফেস গ্রিন । এটাই কলম্ব শহরের সবচাইতে সুন্দর ভিউ পয়েন্ট । একপাশে সুউচ্চ বিল্ডিং, কলম্বো এর বেশিরভাগ হাইরাইজ টাওয়ার হয় ব্যাংক নয়ত হোটেল । হোটেলের সংখ্যাই বেশি । তারপর সবুজ ঘাস এবং এর পর সৈকত , রয়েছে অসংখ্য স্ট্রিট ফুড এর দোকান তবে কোথাও নোংরা নেই । চেন্নাইতে একই রকম সমুদ্র সৈকত এ গিয়েছিলাম সেখানের বীচ প্রচুর নোংরা ছিল ।
হোটেল, কোথায় , খরছ কেমন?
সারাদিনের ক্লান্তি আর গরমে মাথা ব্যাথা ধরে গিয়েছিল, একটু বিশ্রাম প্রয়োজন । হোস্টেল আগে থেকেই বুক করা ছিল , নাম মিরাকল সিটি হোস্টেল , শহরের একদম মাঝামাঝি বলা যায় , যেহেতু আমাদের বাজেট ট্যুর । তাই আমরা আগে থেকে খোজ খবর নিয়েছিলাম কম খরচে কোথায় থাকা যায় । এটা একটা ডরমেটোরি টাইপের রুম, চাইলে আপনি একাও থাকতে পারবেন । হোস্টেল এর মত এক রুমে ৪-৮ জন থাকা যায় । জনপ্রতি ভাড়া ২০০০ রুপি, এর মানে প্রায় ৭০০ টাকা । ছাদের উপরে আড্ডার দারুন সুব্যাবস্থা । হোটেলের মত আলাদা করে রুমের ভিতরে বাথরুম নেই তবে বাইরে সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে । কম সংখ্যক মানুষের জন্য বাজেটের ভেতরে ভাল ব্যবস্থা । আবার পাশেই রুটি- ফ্রাইড রাইস খাওয়ার ব্যবস্থা ।
মিরাকল সিটি হোস্টেল এর ঠিকানাটা বলে দিলামঃ
103 Muhandiram's Rd, Colombo 00300, Sri Lanka
ফোন নাম্বারঃ +94718998999
এই লিংকগুলোতে ক্লিক করে বুক করতে পারবেন ।
এই হোস্টেলের পাশে সুন্দর একটা মসজিদ রয়েছে । চাইলে হোস্টেল থেকে হেটে দুই মিনিটে মসজিদে চলে যেতে পারবেন ।
খাওয়া দাওয়া কেমন?
কলম্বো আসার আগে সবচাইতে বেশি ভয় ছিল যে বিষয় নিয়ে সেটা হচ্ছে খাবার কেমন হবে? সব খাবারই নাকি নারিকেল তেল দিয়ে রান্না করে । তবে একবেলা খাবারের পরই ভয় কেটে গেল । নারিকেল তেল ছাড়াও খাবার পাওয়া যায়, যদিও নারিকেল তেল দেয়া খাবার ও খুব একটা খারাপ না, আমি একটু ট্রাই করেছি । কিন্তু খাবারের দাম অনেক বেশি । সিএনজি ভাড়া সস্তা দেখে ভেবেছিলাম খাবারও সস্তা হবে । মোটামুটি পেট ভরে খেতে গেলে আপনাকে ৪০০-৫০০ টাকা খরচ করতে হবে, আমাদের দেশে ২০০-২৫০ তে এটা সম্ভব । খাবারের দোকানের পরিচ্ছনতা বেশিরভাগ জায়গায় ভাল । আমাদেরকে যে চামচ দিল সেটা গরম পানিতে ধুয়ে দিল । শ্রীলঙ্কানরা জাতি হিসেবে অনেক অথিতিপরায়ন । আমাদের মত ডিম পাড়া হাস একবারে খেয়ে ফেলার মানসিকতা নেই ।
ক্রো আইল্যান্ড বীচঃ
কলম্বতে আমরা আরেকটা বীচ এ গিয়েছিলাম এটা শহরের প্রায় শেষ সীমানাতে বলা চলে । এটার নাম ক্রো আইল্যান্ড । এখানে বিশ্রাম নেয়ার চমতকার ব্যাবস্থা রয়েছে । লোকজন পরিবার পরিজন নিয়ে ঘাসের উপরে চাদর বিছিয়ে বসে আছে । একপাশে দিগন্ত জোড়া সাগর । পাশে বাচ্চারা খেলাধুলা করছে । অদ্ভুত প্রশান্তির এক অনুভুতি । আমাদের দেশে এমন সুযোগ কম । কিছু কিছু জায়গা গুলোতে যা সুযোগ আছে সেখানে নানান বানিজ্যিক কার্যক্রম , চটপটি ফুচকার দোকান, হকারের যন্ত্রনা , চিপস চানাচুরের প্যাকেট । সবমিলিয়ে মানসিক প্রশান্তি পাওয়ার সুযোগ কম । দুই দেশের এসব পার্থক্য প্রতিনিয়ত কষ্ট দিচ্ছিল । শ্রীলংকাতে প্রচুর কাক , এই কাক থেকেই এর নাম ক্রো আইল্যান্ড হয়েছে কিনা কে জানে?
যাতায়াত
দুই বা তিনজন হলে পিক মি এপ্স ব্যাবহার করে টুকটুক নিয়েই সম্পূর্ণ শ্রীলংকা ঘুরে দেখতে পারেন । ৪ জন হলে নিতে পারেন গাড়ি , কলম্বো শহরজুড়েই আছে বাসের ব্যবস্থা , তবে ভাষাগত সমস্যার কারনে আমরা তা ট্রাই করিনি । মজার বিষয় হচ্ছে কলম্ব থেকে এয়ারপোর্ট যাওয়ার সময় আমরা বাসে করে ফিরেছিলাম এতে সময় একটু বেশি লাগলেও ১৫০০ রুপি খরচ বেচে গিয়েছিল । এই রুপিগুলো এখনো আমার কাছে রেখে দিয়েছি স্মৃতি হিসেবে ।
পিক মি এপস ডাউনলোড করতে পারবেন এই লিংক থেকে । এটা আমাদের দেশের পাঠাও এর মত ।
এয়ারপোর্ট গামি এই বাস পাবেন পেটাহ বাসস্ট্যান্ড থেকে । পেটাহ বাসস্ট্যান্ড স্টেশনের কাছেই অবস্থিত ।পেটাহ হচ্ছে কলম্বোো এর নিউমার্কেট । এখানে কমদামে অনেক কিছু পাওয়া যায় ।
কলম্বো শহর খুব ভাল লাগার মত একটা শহর । চাইলেই চলে যাওয়া যায় সাগর দেখতে । রাস্তা সুশৃঙ্খল , আমাদের সাউথ এশিয়ার বড় শহরের মত প্যা পু কম । চলাফেরা করে শান্তি । তবে হাতে সময় কম থাকলে মানুষ কলম্বো থাকে কম কারন এই দেশে আরও অনেক চমতকার জায়গা রয়েছে যেগুলোতে সময় দিতে পারবে বেশি । এই শহরটা মুলত একটা হাব । যাওয়া ও আসার পথে চলতি পথের এক শহর !
আশা করছি ভাল লেগেছে । কলম্বো নিয়ে আমার এই ইউটিউব ভিডিও দেখার আমন্ত্রন রইল । ধন্যবাদ । কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না ।
0 মন্তব্যসমূহ