সিক্কিম , গোয়ার পর ভারতের সবচাইতে ক্ষুদ্র রাজ্য । একি সাথে ভারতের সবচাইতে আকর্ষণীয় ভ্রমনকেন্দ্র গুলোর মধ্যে একটি ।
যারা সিকিম যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন বা ভবিষ্যতে যাবেন আজকের এই পোস্ট তাদের জন্য । সাথে শেয়ার করব আমার সিকিম ভ্রমনের কিছু এমন কিছু অভিজ্ঞতা যা জেনে রাখলে আপনার সিকিম ভ্রমনটা আরও সুন্দর হতে পারে । সাথে সবার শেষে জানিয়ে রাখছি আমার সিকিম ভ্রমনের কিছু ভুল যাতে আপনারা এই ভুলগুলো না করেন ।
যারা সিকিম যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন তারা নিশ্চয়ই এত দিনে জেনে গিয়েছেন সিকিম ভারতের উত্তরের একটি রাজ্য যা নেপাল, ভুটান এবং চীনের সীমান্তের একদম পাশে । ভুরাজনৈতিক ভাবে এই রাজ্য ভারতের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ আর তাই সিকিমে বিদেশিদের ভ্রমনে রয়েছে কিছু সতর্কতা । সিকিমে তাই ভ্রমনের পূর্বে বাংলাদেশি হিসেবে আপনাকে অবশ্যই ভারত সরকারের অনুমোদন নিয়ে যেতে হবে । এই অনুমোদনের চারটি উপায় রয়েছে । আমি শেয়ার করব যেটি সবচাইতে সহজ সেই উপায় টি । বাকি ৩ টার কথা বলে মাথা খারাপ করতে চাইনা।
সিকিম / গ্যাংটক কিভাবে যাবেন?
সিকিম হচ্ছে ভারতের একটি রাজ্য আর সেই রাজ্যের রাজধানির নাম হচ্ছে গ্যাংটক ।
আপনি যেভাবেই সিকিম বা গ্যাংটক যান না কেন, সহজভাবে যেতে চাইলে আপনাকে শিলিগুড়ি বা নিউ জলপাইগুরি থেকে যেতে হবে । বাংলাদেশ থেকে কয়েকভাবে শিলিগুরি যেতে পারবেন । যেমনঃ
১. ঢাকা থেকে বাসে করে বুড়িমাড়ি বন্দর / বাংলাবান্ধা ( ফুলবাড়ী / চ্যাংরবান্ধা) অথবা ট্রেনে করে মিতালি এক্সপ্রেস (ঢাকা বা তার আশে পাশের এলাকা থেকে এটি সবচাইতে সহজ উপায় ।)
# মিতালী ট্রেনে যাওয়ার ক্ষেত্রে 'By rail New jalpiguri port ভিসাতে থাকতে হবে।
২. বেনাপোল বন্দর হয়ে কলকাতা , এরপর কলকাতা থেকে ট্রেনে শিলিগুড়ি । যারা বেনাপোল বন্দরের আশেপাশে থাকেন এই পথটি তাদের জন্য ।
৩. ডাউকি বন্দর দিয়ে শিলং হয়ে গোহাটি , গোহাটি থেকে ট্রেনে শিলিগুরি (শিলং থেকে বাসে করেও শিলিগুড়ি যেতে পারবেন ) । সিলেট থেকে এটি কাছে ।
৪. আগরতলা বন্দর হয়ে আগরতলা এয়ারপোরট সেখান থেকে ফ্লাইটে বাগডগরা এয়ারপোর্ট । ফ্লাইটরেট কম হলে এটি বেশ ভাল একটি উপায় ।
শিলিগুড়ি বা নিউ জলপাইগুড়ি নামার পর আপনাকে অনেক দালালরা ঘিরে ধরবে তাদের ট্রাভেল এজেন্সির গাড়ি বা প্যাকেজ নেয়ার জন্য । ভুলেও এই কাজ করবেন না । কারন শিলিগুড়ী বা জলপাইগুড়ী প্যাকেজওয়ালারা আপনাকে অনেক ভয় দেখিয়ে বা ভুল তথ্য দিয়ে বাড়তি টাকা দিয়ে প্যাকেজ ধরিয়ে দিবে । তাদের কথা এবং কাজের কোন ঠিক নেই । রুম বা গাড়ি দেখাবে এক দিবে আরেক । কমপ্লেন করলে উলটা আপনাকে দোষী বানিয়ে দিবে । তাই সাবধান ! সাবধান ! সাবধান !
তাহলে উপায়?
শিলিগুড়ি বা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে অনেক প্রাইভেট ট্যাক্সি বা শেয়ারড সুমো পাওয়া যায় । এগুলোর একটি ধরে চলে যান । বাসেও যেতে পারেন সময় একটু বেশি লাগবে । ট্যাক্সিতে সময় লাগবে সাড়ে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা । পথে দুই এক জায়গায় থামতে চাইলে ট্যাক্সিতে উঠার আগেই বলে নিবেন । ভাড়া নিবে ২৫০০-৩০০০ রুপি । শেয়ারড সুমো পার সিট ৪৫০ টাকা । আমি ভেবেছিলাম সুমোতে জার্নি বেশ কষ্টকর কিন্তু সুমো গাড়ি চড়ার পর মনে হয়েছে এটি তুলনামুলক আরামদায়ক এবং সময় সাশ্রয়ী ।
গ্যাংটকে প্রচুর হোটেল রয়েছে । ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললেই নিয়ে যাবে ।
সবচাইতে সহজে পারমিশন নিব কোন জায়গা থেকে ?
এক কথায় রাংপো চেকপোস্ট । সিকিম ঢোকার গেট এর আগেই এই চেকপোস্ট । এখান থেকে আপনি পাসপোর্টে অনুমোদন নিয়ে নিবেন এবং আপনাকে একটি কাগজ দেয়া হবে । অবশ্যই অবশ্যই অবশ্যই এই কাগজ সাবধানে রাখবেন, হারাবেন না । এবং সিকিম থেকে বের হওয়ার সময় এই কাগজ জমা দিয়ে চেক আউটের সিল নিবেন, অন্যথায় আর কখনই সিকিম প্রবেশ করতে পারেবেন না ।
ট্যুর প্ল্যান কিভাবে করবেন?
সিকিমের মুল আকর্ষণ হচ্ছেঃ লাচুং , ইয়াম্থাম ভ্যালি , জিরো পয়েন্ট ( এগুলো নর্থ সিকিমে একি রাস্তায় পরেছে) সাঙ্গু লেক লেক ( এটি আরেক রাস্তায় ) । তিনদিন সময় নিলে এগুলো ঘুরে দেখতে পারবেন । আর যদি গ্যাংটক এর আশপাশ ঘুরে দেখতে চান তবে আরেক দিন। গ্যাংটকে যে সকল প্যাকেজ এর অপারেটর রয়েছে তাদের সাথে কথা বললেই তারা সব ব্যবস্থা করে দিবে ।
সিক্কিম এর ৪ টা পার্ট , সব গুলো ঘুরে দেখতে চাইলে সময় নিয়ে আসতে হবে আপনাকে ।
সিকিম যাওয়ার সবচাইতে ভাল সময় কোনটি ?
সিকিম যাওয়ার সবচাইতে ভাল সময় এপ্রিল মাস । এসময় বরফ আর পাহাড়ে নানান রঙ এর ফুল দেখতে পাওয়া যায় । মে থেক জুলাই-অগাস্ট এ বর্ষাকাল থাকে এসময় সিকিম ভ্রমন বেশ বিপদজনক । কারন এসময় বন্যা , পাহাড়ধ্বসের ঘটনা ঘটে । বরফ দেখতে চাইলে নভেম্বর এর পর যাওয়া ভাল । তবে বরফের সময় আর বরফ ছাড়া সিকিমের সৌন্দর্য দুই রকম সুন্দর । ঠান্ডার সময় সবধরনের শীতের পোশাক সাথে রাখবেন । সাথে ছাতা রাখাটা ভাল ।
গ্যাংটক এর কোন দিকে হোটেল নিলে ভাল ভিউ পাওয়া যায়?
গ্যাংটক এর বাজরা রোডে যে সব হোটেল রয়েছে সেখান থেকে পাহাড়ের বেশ ভাল ভিউ পাওয়া যায় , তবে এদিকে খাবারের হোটেল এর কমতি রয়েছে , তাছাড়া মুল শহর থেকে এটি এক কিলোমিটার বাইরে, তাই কোন প্রয়োজনে জনপ্রতি ৩০ রুপি খরচ করে ট্যাক্সি নিয়ে শহরে যেতে হয় , যারা নিরিবিলি পছন্দ করেন তাদের জন্য এটি ভাল ।
খাবারের জন্য মুসলিম হোটেল বা হালাল খাবার কি রয়েছে?
রয়েছে , মহাত্মা গান্ধী রোডে মুসলিম বা হালাল হোটেল রয়েছে ।
সিকিম এ কি বাচ্চা বা বড়দের শ্বাসকষ্ট হয়?
সাধারনত এ ধরনের ঘটনা ঘটেনা । তবে যাদের খুব বেশি এজমা আছে তাদের ক্ষেত্রে হতে পারে , এক্ষেত্রে গ্যাংটক এ অক্সিজেন টিউব এর ব্যবস্থা রয়েছে । গ্যাংটক ৫৫০০ ফিট উপরে , লাচুং ৮০০০ ফুট উপরে এবং ইয়ামথাম ভ্যালি ১২০০০ ফুট উপরে । ইয়াম্থাম গিয়ে আমি বাচ্চা কোলে নিয়ে ভ্যালিতে হাটাহাটি করেছি আমার বাচ্চা দৌড় ঝাপ দিয়েছে, কোন সমস্যা হয়নি ।
শহরে কি এটিএম বুথ এভেইলেভল?
শহরে অনেকগুলো এটিএম বুথ রয়েছে ।
তবে লাচুং , ইয়ামথাম বা সাংগু লেক এ পাবেন না । এসকল স্থানে যাওয়ার আগেই টাকা তুলে রাখবেন ।
আরও কিছু জরুরি বিসয়ঃ
১. যাওয়ার আগে ২ X ২ ছবি , পাসপোর্ট ও ভিসার ফটোকপি সাথে রাখবেন 6 কপি (কমপক্ষে) ।
২. গ্যাংটক এ প্রকাশ্যে ধুমপান নিষিদ্ধ ।
৩. সিকিম এর ভেতরের কিছু পর্যটন স্পট বেশ ভেতরে এবং পাহাড়ী রাস্তা । যাদের বমির সমস্যা রয়েছে তারা প্রস্তুতি নিয়ে যাবেন । যেসব বাচ্চারা এক জায়গায় দীর্ঘক্ষণ বসতে চায়না তাদের নিয়ে ভ্রমন কস্টকর হতে পারে .
৪. শিলিগুড়ি বা নিউজলপাই গুড়ি থেকে ভুলেও প্যাকেজ নিবেন না ।
আমার সিকিম ভ্রমনের কিছু অভিজ্ঞতাঃ
আমার সাড়ে তিন বছরের ছোট মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে সিলেট থেকে সড়কপথে আমি সিকিম ভ্রমন করি । একারনে আমাকে সিলেট থেকে গ্যাংটক পর্যন্ত প্রায় ২০ ঘন্টা ভ্রমন করতে হয়েছে । এরমধ্যে একদিন প্রচণ্ড গরম থাকায় যাওয়ার পথে আমার স্ত্রী ও মেয়ে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পরেন ।
আমার এই ভ্রমনে সবচাইতে বড় ভুল ছিল , নিউ জলপাইগুড়ি থেকে প্যাকেজ নেয়া । সেই প্যাকেজ অপারেটর কি কি ভাবে আমাকে ঠকিয়েছে তা বলি,
১. যাওয়ার সময় আমার সাইট সিয়িং করে গাড়ি গ্যাংটক পর্যন্ত যাওয়ার কথা থাকলেও , গাড়ির ড্রাইভারকে অনেক অনুরোধের পরও ষে গাড়ি থামায় নি ।একটানা গাড়িতে থেকে আমার মেয়ে ও স্ত্রী গরমে অসুস্থ হয়ে পরেন ।
২. হোটেলে যে রুম দিয়েছে তা বাইরে থেকে ভাল মনে হলেও ভেতরে গুমোট ভাব ও মান সম্মত ছিলনা ।
৩. যাওয়ার সময় শেয়ারড সুমোতে আমাদের চারজন এর মাঝখানে বসে যাওয়ার কথা থাকলেও , সেখান থেকে একজনকে সরিয়ে দেয়া হয় ।
৪. প্যাকেজের ভেতরে খাবার অন্তর্ভুক্ত থাকলেও দেয়া হয় ডিম ডাল আর ভাত, সকালে দুই পিস ব্রেড আর জেলি ।
৫. ফেরার সময় রিজার্ভ গাড়ি দেয়ার কথা মুখে বলে দেয়া হয় রিসিটে লেখা হয় শেয়ারড ট্যাক্সি যা ছিল ভয়াবহ প্রতারনা ।
সবশেষে ক্যাল্কুলেশন করে দেখলাম । আমি যদি নিজে নিজে এই ট্যুর অপারেট করতাম তাহলে আমাকে আরো ৫০০০ রুপি কম খরচ করলেও হয়ে যেত ।
সোজা বাংলায় যাকে বলে "ধরা খাওয়া"
আপনারা তাই ধরা খাবেন না । প্রয়োজনে আমাকে মেইল বা হোয়াটস আপ করতে পারেন।
ইমেইলঃ omarnasif.bd@gamil.com
Whatsapp: +8801717131799
Youtube Channel: Break Rules
0 মন্তব্যসমূহ