সিলেট থেকে কক্সবাজার-বান্দরবান, পাহাড় আর সমুদ্র দেখতে হাজার মাইলের গল্প ।

আমি টাকা জমাতে পারিনা। কারন হাতে অল্প কিছু টাকা জমলেই ট্যুর প্ল্যান করি। কোন মহান ব্যাক্তি বলেছেন টাকা জমাতে জমাতে রাজা হওয়ার চাইতে ঘুরতে ঘুরতে ফকির হয়ে যাওয়া আনন্দের, এই মহান ব্যাক্তি কে, আমার জানা নেই ।



ফুল ফ্যামিলি নিয়ে এটা আমার প্রথম ট্যুর। সিলেট থেকে কক্সবাজার আর বান্দরবান। ৪ দিনে ঘুরে বেড়াব হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ।  ৪ শহর,  ৩ হোটেল,  পাহাড় আর সমুদ্র। উত্তেজনায় এক সপ্তাহ আগে থেকে দিন গুনছি ।


আমাদের যাত্রা শুরু হল সিলেট রেলস্টেশন থেকে । উদয়ন ট্রেনে করে আমরা যাব সিলেট থেকে চট্রগ্রাম পর্যন্ত তারপর সকালে চট্রগ্রাম থেকে বাসে কক্সবাজার । 





উদয়ন ট্রেন সিলেট থেকে ছাড়ে রাত সাড়ে ৮ টায় । তবে কমবেশি প্রায় দিন দেরি করে । আমরা যেদিন যাচ্ছি সেদিন লেট ছিল ২ ঘন্টার মত।


সিলেট থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ৫০০ কিলোমিটার এর ও বেশি। চাইলে সরাসরি বাসে যাওয়া যেত তবে ট্যুরে ট্রেনে চড়ার লোভ বেশিরভাগ সময় সামলাতে পারিনা। একটু আরাম আয়েশে যাব বলে, ১০ দিন আগে অনলাইনে এসি বারথের টিকেট কেটেছি । টাকা লেগেছে পার হেড ১৩৫০ টাকা করে । তাও ভাল একটু নিশ্চিন্তে শুয়ে যাওয়া যায় ।


টিকেট কাটবেন যে সাইট থেকেঃ রেল সেবা

সিলেট থেকে চিটাগাং আসতে সময় লাগল ৯ ঘন্টা। স্টেশনে একটু ফ্রেশ হওয়ার পর চলে যাব নতুন ব্রিজ বাস কাউন্টারে। মারসা বাসে ৪ ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে চলে যাব সমুদ্রের কাছাকাছি। মারসা বাসে জনপ্রতি টিকেটের দাম ৪২০ টাকা । এই রুটে যতগুলো বাস চলে তার মধ্যে মারসা আর সউদিয়ার সার্ভিস ভাল । মানে মন্দের ভাল আরকি ।


অবশেষে ক্লান্ত দেহে আমরা পৌছাই কক্সবাজার । সাগরের সামনে যতবার এসে দাড়াই ততবারই অন্যরকম আনন্দের অনুভুতি হয়। শরির ও মন দুটোই চাঙ্গা হয়ে যায় ।


এবার ইচ্ছা ছিল , সমুদ্রের পাশে সি ভিউ রুমে থাকার জন্য তাই আগে থেকেই গবেষণা করে বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম হোটেল সমুদ্র বিলাস । হোটেলটি সমুদ্রের একদম পাশে অবস্থিত । এখানে রিসিপশন ও রুম থেকে সমুদ্র দেখা যায় । হোটেলটি ফাইভস্টার হোটেল সায়ম্যান বিচ রিসোর্ট এর পাশেই অবস্থিত ।





বারান্দা থেকে সমুদ্রের দৃশ্য শেস ১৪ ঘন্টার ভ্রমনের ক্লান্তি একবারেই মুছে দিল।


আর আমাদের আরো খুশি করতেই কিনা একটু পরেই আকাশে জমল মেঘ ।  বারান্দায় বসে বসে উপভোগ করার মত দারুন ওয়েদার । কক্সবাজারে অনেকবার এসেছি কিন্ত কখনো বৃষ্টি পাইনি । এবার ভাগ্য ভাল ছিল আসার সাথে সাথেই বৃষ্টির দেখা মিলল ।


হোটেল সমুদ্র বিলাস গুগল ম্যাপ লোকেশনঃ হোটেল সমুদ্র বিলাস

ফোন নাম্বারঃ 01813882191


বৃষ্টি শেষ হওয়ার পর সমুদ্র সৈকত দৃশ্য ছিল আরও সুন্দর।  মনে হচ্ছিল সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে এখানেই বাকি জীবন থেকে যাই। 


এমন ওয়দারে দুই একটা  ছবি তোলার জন্য মন টানবে এটা সাভাবিক তবে স্থানিয় ফটোগ্রাফারদের থেকে একটু সাবধানে থাকবেন , কারন তারা একটা দুইটা ছবি তোলার কথা বলে আপনাকে একশ থেকে ২০০ ছবি ধরিয়ে দিবে । 



বিকালে সাগর দর্শন আর সন্ধ্যার চা পর্ব শেষ করে আমরা চলে গেলাম রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ডে । রেডীয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড সামুদ্রিক মাছের বিশাল এক একুরিয়াম । এখানে দেখতে পাবেন । পিরানহা মাছ , সামুদ্রিক কচ্ছপ ,হাংগর রয়েছে কাকড়া ও অদ্ভুত আকৃতির অনেক মাছ । 





পিরানহা মাছ আমি এই প্রথম দেখলাম । চোখের সামনে হাংগর ও এই প্রথম ।


গুগল ম্যাপ লোকেশনঃ রেডিয়েন্ট ফিস ওয়াল


Day 2: 

দ্বিতীয় দিনে কমপ্লিমেন্টরি ব্রেকফাস্ট শেষ করে চলে গেলাম সমুদ্র সৈকত এ । আকাশে রোদ নেই । সাগরে গোসল করার জন্য ভাল ওয়েদার । অফ সিজন ছিল বলে বিচে ট্যুরিস্ট এর সংখ্যাও খুব বেশি না ।



একটু পরে আমাদের হোটেল চেক আউট করতে হবে,  গোসল করে ফিরে এসে বারান্দায় বসে আরাম করে বারান্দায় বসে দেখে নিলাম পৃথিবীর দীর্ঘতম এই সমুদ্র সৈকত । যত দেখি ততই মুগ্ধ হই ।


 আজকে সমুদ্র বিলাস থেকে চেকআউটের পর আমরা চলে যাব হোটেল দ্যা কক্স টু ডে তে । কক্সবাজার আসার আগে থেকেই প্ল্যান ছিল এমন কোন হোটেলে থাকার যেখানে আরাম করে সুইমিং করা যায় ।





কক্স টু ডেতে সি সাইড রুম প্রতি আমাদের খরচ হয়েছে ৫০০০ টাকা । রুম থেকে ঝাউবন দেখা যায় , সাগর দেখা যায়না । সাথে আমরা পাচ্ছি সুইমিং পুল ব্যাবহারের সুবিধা ও কমপ্লিমেন্টোরি ব্রেকফাস্ট । 


 দুপুরের গরম এ সুইমিং পুল এ ঝাপাঝাপি করার মত আনন্দ পৃথিবীতে কমই আছে ।


হোটেল কক্স টু ডে গুগল ম্যাপ লোকেশনঃ Hotel The cox today
Booking Contact Number: 01755598446

কক্সবাজারের একটা মাস্ট সি অপশন হচ্ছে ইনানি বিচ ও হিমছড়ী ।  লাঞ্ছের পর আমরা যাচ্ছি ইনানি বিচ এর উদ্দ্যেশ্যে , একটা অটোরিকশা রিজার্ভ করেছি ৯০০ টাকা দিয়ে ।


একটা ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট জানিয়ে রাখি, কক্সবাজার কিন্ত একসময় আরাকানদের অংশ ছিল । আরাকান মানে মিয়ানমার । পরবর্তিতে মুঘল সম্রাট শাহ সুজা এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এটি নিজেদের অংশে নিয়ে আসেন । সম্রাট শাহ সুজাকে আমার পক্ষ থেকে লাল সালাম । 


ইনানি বিচে সূর্যাস্তের দৃশ্য অনেক সুন্দর । সাধারনত পর্যটকরা এই দৃশ্য মিস করেন না ।


সন্ধ্যায় ক্লান্ত শরীরে ফেরার পর বাড়তি আকর্ষণ যোগ করল হোটেলে বাশির সুর ।


আর এভাবেই কক্সবাজারে কেটে গেল আমাদের দ্বিতীয় দিন।


Day 3:


ডে থ্রিতে আমরা চলে যাব বান্দরবান । ১২ টায় বাস । যাওয়ার আগে আরেকবার ঝাপ দিলাম সুইমিং পুল এ । আগের দিন সুইমিং করতে আমাদের অনেক ভাল লেগেছিল ।


পুরবি বাসে করে রওনা দিলাম বান্দরবানের উদ্যেশ্যে । সময় লাগবে সাড়ে ৩ ঘন্টা ।


বান্দরবান আসার সময় অবশ্যই আপনার আইডী কার্ড আপনার সাথে রাখবেন । ক্যান্টনমেন্ট চেকপোস্ট এ আপনার আইডি কার্ড সেনাবাহিনি সদস্যরা দেখতে চাইবে ।


বান্দরবান এসে আমরা উঠলাম হোটেল হিলভিউতে । হোটেলটি বাসস্ট্যান্ডের একদম পাশে । তাই এখানে ভাড়া বান্দরবানের হিসাবে তুলনামুলক একটু বেশি । 


হোটেল এসে ফ্রেস হয়ে আমরা বের হয়ে পরলাম নিলাচলের উদ্যেশ্যে ।





১৬০০ ফুট উচু নিলাচলকে বাংলাদেশের দারজিলিং বলা হয় । নিলাচল বান্দরবান শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । 


নিলাচলের পাহাড় থেকে বান্দরবান শহর দেখা যায় আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে দেখা যায় বঙ্গোপসাগর । আমাদের প্ল্যান  ছিল নিলাচলের পাহাড়ের উপর রিসোর্ট এ থাকা, কিন্তু, আগে থেকে বুকিং দিতে পারিনি বলে এবার আর থাকা হয়নি , আপনারা কিন্ত এই সুযোগ হাতছাড়া করেবেন না । বুকিং এর নাম্বার নিচে দেয়া থাকল ।


সন্ধ্যার সময় নিলাচল অনেক সুন্দর । দুরের পাহাড়ে একটা দুইটা লাইট আস্তে আস্তে জ্বলে উঠে , এই দৃশ্য দেখতে খুব ভাল লাগে আমার । 


নিলাচল পর্ব শেষে রাতে আমরা বের হলাম হেটে হেটে বান্দরবান শহর দেখতে , দেখতে দেখতেই বৃষ্টি চলে এল।


Day 4:

ডে ফোর এ প্ল্যান ছিল আমরা নিলগিরি পরযন্ত যাওয়ার তবে একিদিনে আমাদেরকে জার্নি করে আবার সিলেট ফিরতে হবে তাই ঠিক করি চিম্বুক পাহাড় পরযন্ত যাব ।


চিম্বুক পাহাড় যেতে সময় লাগবে ১ ঘন্টা ।


যাওয়ার পথে  শৈলপ্রপাত এ আমরা একটু ব্রেক নেই আর তখনি আকাশ ভেংগে নামল  বৃষ্টি । এখানে বসে অনেকসময় বৃষ্টি উপভোগ করলাম ।  পাহাড়ে এমন বৃষ্টি দেখার সৌভাগ্য সবসময় হয় না।


বৃষ্টির কারনে চিম্বুক যাওয়ার প্ল্যানটা বাদ দিতে হল । একটা জিনিস খেয়াল করবেন পাহাড়ে যখন বৃষ্টি হয় তখন সবুজের অনেকগুল শেড দেখা যায় ।





চিম্বুক যেতে না পারলে বৃষ্টিতে শৈলপ্রপাত এর সৌন্দর্য আমাদের এই ট্যুরকে পরিপূর্ণ করে তুলল। সৃষ্টিকর্তাকে অনেক ধন্যবাদ ।


বিকাল সাড়ে ৫ টায় বান্দরবান থেকে লাস্ট বাস ছাড়ে চিটাগং এর উদ্দেশ্যে ।  চিটাগাং নেমে আমরা চলে এলাম লন্ডন এক্সপ্রেসের কাউন্টারে ।


লন্ডন এক্সপ্রেস এর এই ম্যান গাড়ি দিয়ে আমরা চিটাগাং থেকে যাব সিলেট আমাদের সময় লাগবে ৯ থেকে ১০ ঘন্টা । এই বাসের টিকিটের মুল্য ১৫০০ টাকা। এই রুটে লন্ডন এক্সপ্রেসের স্লিপার গাড়ীও পাওয়া যায় ।


৭ জনের এই টীমে জনপ্রতি আমাদের খরচ হয়েছে দশ হাজার টাকার মত , ফ্যামিলি নিয়ে এসেছি বলে চেস্টা করেছি সবকিছুই যাতে একটু আরামে হয় । 





সব মিলিয়ে অনেকদিন মনে রাখার মত ছিল এবারের ছুটি ।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ